পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২৭, ২০১১

নাট্যগুরু আসকার ইবনে শাইখ

আসকার ইবনে শাইখ একাধারে নাট্যকার, গীতিকার, সংগঠক, অভিনেতা, গাল্পিক, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাসৈনিক, ইতিহাসবেত্তা ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। পূর্ব-বাংলার মুসলিম সমাজজীবননির্ভর প্রথম নাটক ‘বিরোধ’ রচনা করেন তিনি। নাটকটি সে আমলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকের মধ্য দিয়ে আসকার ইবনে শাইখ পথিকৃত নাট্যকারের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
আসকার ইবনে শাইখের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। আসকার ইবনে শাইখ তার লেখক নাম এবং এ নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। শাইখের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ মার্চ মোমেনশাহী জেলার গৌরীপুর থানার মাইজহাটি গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই নাটকের প্রতি ছিল তার দুর্দমনীয় আকর্ষণ। শাইখ মোমেনশাহী জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি জড়িত হন ভাষা আন্দোলনের পথিকৃত সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে। এ সংগঠন থেকে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের পাশাপাশি প্রকাশ হতো মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্যুতি’। এ পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন আসকার ইবনে শাইখ। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর।
পেশায় শিক্ষক হলেও নাটকের নেশায় তিনি ছিলেন সারাজীবন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এদেশের আধুনিক নাট্যজগতের ভিত্তিভূমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন আসকার ইবনে শাইখ। নাটক রচনা, নাট্য সংগঠন পরিচালনা, নির্দেশনা, অভিনয়সহ নাটকের সব ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরণ। মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা সব মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। পূর্ববাংলার গণমানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল আসকার ইবনে শাইখের নাটক। জননেতা মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন তিনি। মওলানা ভাসানী আসকার ইবনে শাইখের নাটককে মূল্যায়ন করতেন ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। যে জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল সে জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্রই পরিদৃষ্ট ছিল শাইখের নাটকে। ফলে মওলানা তাকে দেখতেন গণমানুষের জীবনের রূপকার হিসেবে।
আসকার ইবনে শাইখ রচনা করেছেন বিপুল সংখ্যক নাটক। শুধু সামাজিক নয়, এদেশের মানুষের গোটা ইতিহাসকেও তিনি রূপান্তর করেছেন তার নাট্যকর্মে। আজও অনবদ্য অক্ষয় হয়ে আছে তার কীর্তি ‘রাজ্য-রাজা-রাজধানী’। এদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসও হয়ে উঠেছে তার নাটকের উপজীব্য, লিখেছেন ‘কন্যা-জায়া-জননী’। এ দুটি বিশেষ নাট্যক্রম বাংলা নাটকের ইতিহাসে পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এছাড়াও তার নাটক পদক্ষেপ (১৯৪৮), বিদ্রোহী পদ্মা (১৯৪৮), দুরন্ত ঢেউ (১৯৫১), শেষ অধ্যায় (১৯৫২), অনুবর্তন (১৯৪৩), বিল বাঁওড়ের ঢেউ (১৯৫৫), এপার ওপার (১৯৫৫), প্রতীক্ষা (১৯৫৭), প্রচ্ছদপট (১৯৫৮), লালন ফকির (১৯৫৯), অগ্নিগিরি (১৯৫৮), তিতুমীর (১৯৫৭), রক্তপদ্ম (১৯৫৭), অনেক তারার হাতছানি, (১৯৫৭), কর্ডোভার আগে (১৯৮০), রাজপুত্র (১৯৮০), মেঘলা রাতের তারাসহ (১৯৮৭) অধিকাংশ নাটকই ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘদিন তিনি তার নিজবাসায় একটানা নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজটি করেছেন একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। যার ফলে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন। আসকার ইবনে শাইখ পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যকার, অভিনেতা ও কলা-কুশলীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি কিংবদন্তি নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক ‘বাসন’ও সাক্ষ্য দেয় সেলিম কীভাবে শাইখের উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছেন। শাইখ তার মেধা-প্রতিভা, সৃজনক্ষমতা ও দায়বোধের প্রকাশ এমনভাবে ঘটিয়েছেন যে, সেই পঞ্চাশের দশক থেকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে তিনিই ছিলেন এদেশের নাট্যগুরু। এই সর্বজন স্বীকৃত নাট্যগুরু ইন্তেকাল করেন ২০০৯ সালের ১৮ মে রাজধানীতে তার নিজ বাসভবনে।
এদেশের মুসলিম সমাজজীবনে বিশেষ করে নগরকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষিত একশ্রেণীর সংস্কৃতিসেবীর ওপর সেকুলারিজমের ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এক সময় ধীরে ধীরে আসকার ইবনে শাইখ নামটি আড়ালে পড়ে যায়। কেননা সেকুলাররা মনে করেন শাইখের নাম উচ্চারিত হলেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছুটে আসবে। ফলে মৃত্যুর পূর্বে প্রায় দেড়-দুই দশক তিনি অনেকখানি অন্তরালে চলে যান। কিন্তু তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সে ইতিহাস জীবদ্দশায়ই তাকে পরিণত করে কিংবদন্তিতে। বর্তমানে তার নাটক ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তেমন কোনো তত্পরতা না থাকলেও এটা অসম্ভব নয় যে, এদেশের জনগণ একদিন তার সৃষ্টিকর্মকে নবজাগরণের হাতিয়ার বানিয়ে তুলবে এবং যে মহত্ তত্পরতায় তিনি তুলে এনেছেন জীবন ও ইতিহাসের বিচিত্র দৃশ্যাবলী তার যথাযথ মূল্যায়ন হবে।