পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ১৮, ২০১১

স্মরণীয় পরিচালক জহির রায়হান

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- এই গানখানি প্রথম চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। সেদিনের চলচ্চিত্র দর্শকরা আজও ভোলেননি জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কথা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি বানিয়ে অমর হয়ে রইলেন জহির রায়হান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি নির্মাণের আগে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা ‘অমর ৮ই ফাল্গুন’ নামে ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেলেন না। যে জন্য প্রথম দিকে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ছবি করার সুযোগ পাননি তিনি। তবে এ জন্য জহির রায়হান পিছপা হননি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের চিত্র তুলে ধরার জন্য ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে ছবি না বানালেও বানিয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবিতে ঠিকই একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তুলে ধরলেন। ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ রিলিজের পরে বাঙালি দর্শকরা বুঝতে পারল, পশ্চিমাদের সঙ্গে আর নয়। দলে দলে লোকজন এ ছবি দেখার পরে সবার মুখেই ফিরতে লাগল—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। এ ছবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল’ গানখানিও ছিল। ছবিঘরে বসে এই গান শুনতেই সেদিন জনতার দেহের পশম দাঁড়িয়ে গেল। এদিকে রক্ত টগবগ করে উঠল। বাঙালিরা স্লোগান তুলল—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলা মাকে মুক্ত করো।’ জহির রায়হান শুরু থেকেই পরিচ্ছন্ন ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন। জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি ১৯৭০ সালে গুলিস্তানসহ ঢাকার ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। মুক্তির আগে ছবিটি সেন্সরে আটকে দেয়। পরে এটি তত্কালীন সরকার রিলিজ দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির তিন দিন পরে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্র আন্দোলন হওয়ার কারণে তত্কালীন সরকার ছবিটি প্রদর্শনের জন্য আবার অনুমতি দেয়। জহির রায়হান একাধারে সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক রাজনৈতিক কর্মী, প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। জন্ম তাঁর ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে। তাঁর আসল নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম ছিল ‘জাফর’। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের পরিবার ছিল তাদের। বড় ভাই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)। জহির রায়হান ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। এক বছর পর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক, ‘প্রবাহ’-এর সম্পাদক এবং ‘এক্সপ্রেস’-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানী, সিনেমা, যুগের দাবি প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জহির রায়হান চলচ্চিত্রে প্রথম যোগ দিয়ে ছিলেন এজে কারদারের সহকারী হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৭) ছবিতে। ১৯৬০ সালে প্রথম পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ ছবিটির মাধ্যমে। জহির রায়হান পরিচালিত কাঁচের দেয়াল ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।‘কাঁচের দেয়াল’ পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির সম্মান অর্জন করেছিল। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংগম (১৯৬৫, এটি ছিল রঙিন ছবি), বাানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭) প্রভৃতি। তাঁর প্রযোজিত ছবি হলো-জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), মনের মতো বউ (১৯৬৯), শেষ পর্যন্ত (১৯৬৯) এবং প্রতিশোধ (১৯৭০)। প্রামাণ্য চিত্র হলো—স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), বার্থ অব এ নেশন (১৯৭১), লিবারেশন ফাইটার্স (১৯৭১) এবং ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স (১৯৭১)। তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো—শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), বরফ গলা নদী (১৯৬৯), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি কলকাতায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’ গঠন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে তিনি নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের স্ত্রী সুমিতা দেবী। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিটি নির্মাণের সময় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করন।