পৃষ্ঠাসমূহ

অক্টোবর ১০, ২০১৩

নকুলের মাতৃশোক



‘যারা মাকে ভালোবাসো না, তারা আমার গান শোনে না’ গানটি গাইতে গাইতে চোখ ভিজে ওঠে নকুলের। ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছেন। কিন্তু শিশুমনে মাকে হারানোর যে প্রগাঢ় বেদনা তা আজও মুছে যায়নি। তাই মায়ের জন্য গাইতে গেলেই তার চোখ ভিজে ওঠে। বুধবার বাংলামেইলের সঙ্গে কথা বলার সময় এমনটাই জানালেন কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গীতিকার নকুল কুমার বিশ্বাস।
অথচ এই শিল্পী যখন সমাজ বাস্তবতা নিয়ে তার শ্লেষাত্মক মজার গানগুলো গাইতে থাকেন নিজস্ব বৈচিত্র্যপূর্ণ সুর স্বর আর অঙ্গভঙ্গিতে তখন হাসতে হাসতে দর্শকদের পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগার হয়।
কিন্তু এখন থাক ওসব শ্লেষ, বিদ্রুপ আর কৌতুক। নকুল এবার মাকে নিয়ে লেখা গানগুলোকে নিয়েই সাজাতে চান নতুন অ্যালবাম। ‘যারা মাকে ভালোবাস না’, ‘এই জীবনের সব অর্জন’, ‘আয় রে খোকা আয়’, ‘মামা বাড়ি’, ‘মা আমার বলতো খোকা রে’ মাকে নিয়ে লেখা এমন গানগুলো নিয়ে এবার বিশ্ব মা দিবসে আসছে নকুলের নতুন অ্যালবাম।
মাকে নিয়ে এ অ্যালবামটি নকুলের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেটির কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। তাই আমাদের পেছন ফিরতে হয়। পাঠ করতে হয় একজন সুরক্রিড়ানক নকুল কুমার বিশ্বাসকে।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালে মাদারীপুর জেলার দত্ত কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামের এক সংগীত পরিবারে জন্ম নকুল কুমার বিশ্বাসের। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। মা ও বাবা প্রয়াত সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও শ্রীমতি মঙ্গলী দেবী।
মঙ্গলী দেবীর কোলে আদর আর ভালোবাসায় ছোট্ট নকুলের যখন হেসে খেলে বেড়ানোর কথা তখনই মাকে হারাতে হয়েছে। মাত্র ছয় বছর বয়স তখন তার। মাকে হারিয়ে ব্যাথার সাগরে যখন ভাসছেন তখন তিনি মেজভাই হীরালাল বিশ্বাসের হাত ধরে গোপালগঞ্জে আসেন। লক্ষ্য ছিল যাত্রাদল দীপালি অপেরায় শিশুশিল্পী হিসেবে একটা সুযোগ পাওয়া। সুযোগ মিললোও।
শিশু নকুল অডিশনকক্ষে ছোট্ট আঙুলের ডগা দিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলে মিষ্টি কণ্ঠে শুনিয়ে গেলেন একের পর এক গান। সেদিন নকুলের গান শুনে অবাক বনে গিয়েছিল উপস্থিত সবাই। সেই থেকেই তো শুরু... আর আজকের এই নকুল যেন সেই বয়স্ক এক শিশুই!
যন্ত্রের সঙ্গেও সখ্য তার বহুদিনের। সুরযন্ত্র নিয়ে খেলেন নকুল কুমার। যারা নকুলকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখেছেন তারা জানেন কী করে পা দিয়েও হারমোনিয়াম বাজাতে হয়! মাদারীপুরের ওস্তাদ রণজিৎ দাইয়ের কাছে হারমোনিয়ামে রাগ সংগীতের তালিম নেন নকুল। অবাক করা ব্যপার হলো, মাত্র ছয় মাসেই এটা আয়ত্ত করেন এবং প্রধান হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে একটি স্কুলের শিক্ষক নির্বাচিত হন তিনি।
শুধু হারমোনিয়ামে ধরা হচ্ছিল না সে সুর। যে সুর নকুল মনে মনে ধরতে চাইছিলেন। যে ব্যথা বুকে বাজছিল তা যে শুধু হারমোনিয়ামে অনুরণিত হতে পারছিল না।
গুরু আশু মিয়ার কাছে বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের গল্প শুনতেন। মনে মনে ঠিক করলেন রবিশঙ্করের মতোই  বিখ্যাত হতে হবে তাকে। ১৯৮০ সালে সে সংকল্প চোখে নিয়েই পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা সম্বল করে পাড়ি জমান কলকাতায়। ছোট্ট নকুল কলকাতায় প্রখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ মোস্তাক আলী খানের নাতি-শিষ্য শ্রী রণজিৎ বিশ্বাসের কাছে যান। কিছুদিন সেতার শেখেন তার কাছে ।
তারপর সেখান থেকে ২৮০ টাকায় কেনেন একটি সেতার। এরপর ফিরে আসেন দেশে। ফিরেই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান, অভিনয়, নৃত্য দিয়ে মানুষের মন জয় করতে থাকেন।
১৯৮৩ সালে বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। আশ্রয় নেন ওস্তাদ আমানউল্লাহ খানের বাড়ির ভাঙা বারান্দায়। তার কাছে কিছুদিন তালিমও নেন।
সে বছরই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উচ্চাঙ্গসংগীতের এক আসরে এককভাবে হারমোনিয়াম বাজানোর সুযোগ পান। উপস্থিত সবাই তার পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাকে কেন্দ্রের তহবিল থেকে এক হাজার টাকা পুরস্কারও দেন। এরপর বেতারে চাকরি হয় তার। কিন্তু চাকরির গণ্ডিবদ্ধ আধারে মন বসেনি নকুলের।
১৯৮৬ সালে তিনি আবারও গ্রামের বাড়ি চলে যান এসএসসি পরীক্ষা দিতে। ওই সময় এক কবিয়ালের কিছু গান সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কবিয়াল গান না দিলে অভিমান হয় তার। নিজেই লেখা শুরু করেন। সেই থেকে আজ অবদি অন্য কারো লেখা গান করেননি তিনি। এসএসসি পাস করে পরের বছর আবার আসেন ঢাকায়।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড এন্টারপ্রাইজের ব্যানারে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘ভাগবত পড়ে ভগবানকে পাইছোনি’।  অ্যালবামটি হিট হয়। একই সঙ্গে গান ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
১৯৯৬ সালে ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত হয় তার গাওয়া ‘দাদা বিয়া করলাম ক্যান’ গানটি। এই গানটি তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপর টানা দশ বছর ইত্যাদিতে জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে জীবনমুখী গান নিয়ে হাজির হয়েছেন।
এর মধ্যে কলকাতার অডিও বাজারে লাগে নকুলের গানের ঢেউ। কলকাতার অডিও কোম্পানি জেএমডি থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় নকুলের ‘নদীয়ার নকুল’ এবং ২০০৩ এএসডি অডিও কম্পানির ব্যানারে প্রকাশিত হয় ‘চাকরি নাই বুড়ো বাবার’ নামে আরেকটি অ্যালবাম। ভারত-বাংলাদেশে মিলে এভাবে তার প্রায় অর্ধশত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গান নিয়ে গেছেন ভারত, হংকং, কাতার, চীন, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেক উপাধিও অর্জন করেছেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তান পলক কুমার বিশ্বাস ও মেয়ে প্রত্যাশা বিশ্বাসকে নিয়ে নকুলের সুখের সংসার।
তার গানের মধ্যে ‘চাচায় চা চায়’, ‘এই আমার পকেটে আছে’, ‘মানুষটা পাঁচ ফিট’, ‘হ্যালো হ্যালো মাই ডিয়ার’, ‘মাগো তুমি যেন না কাঁদো’, ‘পাঁচতলার ওই চিলেকোঠায়’, ‘ভালো হইতে পয়সা লাগে না’ ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।
জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ছেড়ে নকুল নিজেই একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ছন্দে আনন্দ’ পরিচালনা করছেন গত দু’বছর ধরে। আসন্ন ঈদে নকুলের ব্যস্ততা তাই ছন্দ আনন্দ নিয়েই। ঈদের চতুর্থ দিন রাত সাড়ে ৮টায় নকুল কুমার বিশ্বাসকে দেখতে পাবেন দর্শক মাইক্রোফোন হাতে।
এছাড়া চ্যানেল আইতেও একটি লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নিবেন বলে জানান নকুল কুমার বিশ্বাস।
------------------রুদ্র হক

জুলাই ২৮, ২০১১

বাংলা গানের এক অধ্যায়ঃসন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

গৌরি প্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন—‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো।’ আর এই গানে কণ্ঠ দিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তো কিংবদন্তি হয়ে রইলেন। তিনি এ পর্যন্ত ১০ হাজার গান গেয়েছেন, সব গানই তো তাকে খ্যাতি দিয়েছে। সেই কবে ১৯৫৪ সালে অনুপম ঘটকের সুরে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সন্ধ্যা গেয়েছিলেন—‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। এ গান শুনলে বৃদ্ধরাও যৌবনে চলে যেতে যান। তার নামটিই যেন হৃদয়ে ঝঙ্কার তোলে। নামটির এমন মহিমা যে উচ্চারিত হলেই শ্রোতাদের মনের আকাশে এক লহমায় গানের ইন্দ্রধনু ফুটে ওঠে। যে কোনো লগ্নই হয়ে ওঠে গান শোনার। তার নাম শুনতেই কানের ভেতর নাকি মনে কিংবা মাথার ভেতর ভাঙতে থাকে গানের ঢেউ—‘মায়াবতী মেখে আনে তন্দ্রা’, ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’, ‘মধুমালতী ডাকে আয়’, ‘বকম বকম পায়রা’, ‘এ গানে প্রজাপতি’, ‘নতুন সূর্য আলো দাও’, ‘ওগো মোর গীতিময়’, ‘চন্দন পালংকে শুয়ে’, ‘মধুর মধুর বংশী’, ‘কুহু কুহু কোয়েল’, ‘নেবো না সোনার চাঁপা’, ‘সজনী ও সজনী’, ‘আমি প্রিয়া তুমি প্রিয়’, ‘ও ঝরা পাতা এমনি তুমি’, ‘হাতে কোন কাজ নেই’, ‘যেখানে স্বপ্ন সুরে রইবে ভরে’, ‘না হয় রহিতে কাছে’, ‘বাঁশি বুঝি আর নাম জানে না’, ‘বধূয়া এলো না’, ‘চিনেছি তোমারে অচেনার মাঝে’, ‘তোমারে হারানো তো নয়’, ‘চৈতী ফুলের কী বাঁধিস রাঙা রাখী’, ‘পিয়া পিয়া পিয়া যে ডাকে আমায়’—এমনি অসংখ্য গান সঙ্গীত শ্রোতাদের মনে ছড়িয়ে দেয় স্মৃতিমেদুরতার কুয়াশা। বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বয়স এখন প্রায় বিরাশি বছর। এ বয়সে তার দুঃখ আছে। থাকবেই না কেন, তার গাওয়া হিট গান এ প্রজন্মের শিল্পীরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গেয়ে বেশ নামধাম কামাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মনে করেন, কিছু টিভি চ্যানেল ও গান ব্যবসায়ী এ জন্য মুনাফা লুটছে। একদিন যে শিল্পীর নিতান্ত দুরবস্থায় কেটেছে শেষ জীবন, তার গান গেয়েই আজকের শিল্পীদের কত নামডাক। ভীষণ রকমের অবিচার এসব। নতুন শ্রোতারা আসল শিল্পীর কৃতিত্ব জানতেই পারছে না। আমার গাওয়া কত না গান এ প্রজন্মের শিল্পীরা টিভি চ্যানেলে করেন অথচ আমার নামটি তারা একটি বারের জন্যও স্মরণ করেন না। কতই না অকৃতজ্ঞ এ প্রজন্মের শিল্পী ও টিভি চ্যানেলগুলোর প্রযোজকরা।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এ বয়সে আরও মনে করেন, আগের দিনে শিল্পবোধ, নীতি বিসর্জন দিয়ে গান-বাজনা নিয়ে পুরোপুরি ব্যবসা ছিল না। আজকাল শুনি, কেউ সিডিতে গান শুনে গান গেয়ে দেয়। ভাবতে অবাক লাগে, এটা কী সম্ভব। একজন শিল্পী তার জীবনভর শিক্ষায়-সাধনায়-নিষ্ঠায় একটা স্টাইল তৈরি করেন। যেমন—হেমন্ত বাবুর স্টাইল, মান্না বাবুর স্টাইল, মানবেন্দ্র বাবুর স্টাইল অনেক মূল্য দিয়ে তাদের অর্জন করা।
১৯৪৪ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত জগতে আসেন। তার প্রথম রেকর্ডকৃত গান—‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ এবং ‘তোমার আকাশে ঝিলিমিলি করে’। মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাত্ ১৯৪২ সালে তিনি রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করেন। গানটি ছিল ‘যদি বা ফুরালো গান’।
সিনেমায় প্রথম গান করেন ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জন গড়’ ছবিতে। সেই রাই চাঁদ বড়ালের যুগ থেকে এ যুগের সুমনের সুরে গানও করেছেন তিনি।
অতীতের সঙ্গে আজকের তুলনাও করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তার অভিমত, সেসব দিনে শিল্পীরা নিজেদের উজাড় করে দিতেন, আজও রয়ে গেছে সেসব গান। আজকের সবই তো রেডিমেড—গানের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না শিল্পীরা। দুদিনেই লোকে ভুলে যাচ্ছে এসব গান। এসব দেখলে বড় কষ্ট হয়। অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়ের মতো মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করা মানে প্রতিদিনই খানিকটা শেখা। আজকের শিল্পীরা সে সুযোগই পান না। এ নিয়ে আজকের শিল্পীরা আমার কাছেই আফসোস করেন।
এক সময় মুম্বাইয়ের শিল্পীদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছিলেন। এ বয়সে সেসব স্মৃতি এখনও সন্ধ্যার মনে নাড়া দেয়। মুম্বাইতে শচীন দেব বর্মণই তাকে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অনিল বিশ্বাসের সুরে লতার সঙ্গে গান করেছিলেন। সেই সূত্রে লতার সঙ্গে তার খুব ভাব হয়। গীতা দত্তের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়েছিল।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় বাংলা গানের একটা পুরো অধ্যায়। বাংলা সিনেমার প্রথম ‘প্রিমা ডোনা’ কানন দেবীর হাত থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন এই সন্ধ্যা। পরবর্তী চার দশকে (১৯৪৮ থেকে ১৯৮৮) সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা ছবির প্লেব্যাক সম্রাজ্ঞীর আসনে। পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেতে ৬০ বছর ধরে সোনালি ফসল তুলে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন তিনি। তিনি যা অর্জন করেছেন তা মহীরুহের মতোই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই হেমন্ত-সন্ধ্যা, অনুপম-সন্ধ্যা, রবীন-সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র-সন্ধ্যা, মান্না-সন্ধ্যা, শ্যামল গুপ্ত-সন্ধ্যা, সুচিত্রা সন্ধ্যা—এমন বহু উজ্জ্বল অধ্যায় ভরে রেখেছে তার শিল্প জীবনে। এভাবেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় লিজেন্ড হয়ে আছেন, যা সঙ্গীত প্রেমিকদের যে অহঙ্কারী হওয়ার রসদ জোগায়।


মহানায়ক উত্তম কুমার

প্রথমে অরুণ কুমার তারপর নাম পালটে উত্তম কুমার। শুরুর সেই লড়াইটা ছিল ভয়ঙ্কর। ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয়’। তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রতিপক্ষও তখন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সেই ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।’ তাঁর ‘মাচো-হিম্যান’ ইমেজে গত শতাব্দীর পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিরা তখনও আত্মহারা। হৃদয়ের কুঠুরিতে লেখা হয়ে গেছে ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ কিংবা ‘প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া’ এই দুই নাম। তাদের পাশে নবাগত উত্তম কুমার। ভাগ্যিস বসু পরিবার (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল। না হলে আজকের বাঙালি কোথায় পেত এই উত্তম কুমারকে। উডু উডু অ্যালবাট, বঙ্কিম গ্রিবা, হৃদয়ে তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা এগুলোই উত্তমের সাফল্যের তাস। মৃত্যুর ৩১ বছর পরও তাকে নিয়ে এই যে মাতামাতি, পাগলামি এও বা কেন? একটাই উত্তর, তার অব্যর্থ শারীরিক আবেদন।
উত্তম কুমারের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার অহেরিটোলা স্ট্রিটে, মামার বাড়িতে। মৃত্যু ২৪ জুলাই ১৯৮০, বৃহস্পতিবার রাত ৯-৩০ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে।
১৯৩৯ সাল। দেশজুড়ে তখন এক অশান্ত অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। সেই উত্তপ্ত সময়ের মধ্যে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন উত্তমের। একচল্লিশের ২২ শ্রাবণ। ১৫ বছরের অরুণ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায়, লক্ষ মানুষের মিছিল। পরের বছরই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের উন্মাদনায় ভবানীপুরের অলিগলিতে বের হতো অরুণের নেতৃত্বে স্বদেশি প্রভাতফেরি। অরুণেরই লেখা গান তারই সুরে গাওয়া হতো। সে বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং পাস। ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবাবরণ মেইন স্কুল থেকে। ভর্তি হন গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে। ১৯৪২ সালেই নিদান ব্যানারর্জির কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। ১৯৪৪ সালে পৌর কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে ক্যাশিয়ারের চাকরি পান। তবে ২ হাজার টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দিয়ে।
১৯৪৭ সালে প্রথম ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওর ফ্লোরে আসেন উত্তম কুমার। প্রথম অভিনীত ছবি ‘মায়াডোর’ (হিন্দি)। এ ছবিতে কাজ করে দৈনিক পাঁচ সিকি পেতেন। নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় ‘কামনা’ ছবিতে (১৯৪৯)। নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। ‘কামনা’ মুক্তি পাওয়ার পর এটি ফ্লপ করল।
কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বসবাস করতেন। তাদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তম কুমার। আর তার সঙ্গে অবচেতন মনে ছিল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, জ্যোতি প্রকাশ, অসিত বরণ ও রবীন মজুমদারের মতো রোমান্টিক সব নায়কের রূপালি পর্দায় দেখার অদৃশ্য শিহরণ। সে জন্য তিনি ফিল্মে নায়ক হতে পেরেছিলেন। অভিনয়ের চেয়েও তখন তার বড় মূলধন ছিল চেহারা। অথচ উত্তম কুমার প্রথম দিকের কোনো ছবিতেই নায়কের ভূমিকা পাননি। শুধু মুখ দেখানো ছাড়া আর কোনো অস্তিত্বই ছিল না সেখানে তার। সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত, বরং বলা যায় অনুগ্রহের পাত্র হয়েই মাত্র উপস্থিত থেকেছিলেন। মায়াডোর (১৯৪৭), দৃষ্টিদান (১৯৪৮), কামনা (১৯৪৯), মর্যাদা (১৯৫০), ওরে যাত্রী (১৯৫১), নষ্ট নীড় (১৯৫১), সঞ্জীবনী (১৯৫২) প্রভৃতি ছবিতে উত্তম কুমার ছিলেন। এর মধ্যে একটি ছবিও ব্যবসাসফল হয়নি। যে জন্য উত্তম কুমার তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন।
১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি দিয়েই উত্তম কুমারের জয়যাত্রা শুরু। নায়িকা সুচিত্রা সেন। প্রায় ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া গেল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। বাংলা ছবিতে যে ভাটার টান অনুভব করা যাচ্ছিল, সেই স্তিমিত জলে সহসা আবেগ সঞ্চার করল ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটি। বাংলা ছবিতে এলো গ্ল্যামার, দর্শকদের ভালো লাগার সঙ্গে যুক্ত হলো মুগ্ধতা। নায়ক থেকে মহানায়কের শীর্ষ আসনটিতে উত্তরণের সঠিক যাত্রারম্ভ হলো এই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। বাঙালি দর্শক সেদিন তাদের আইডিয়াল একজন রোমান্টিক হিরোকে খুঁজে পেলেন উত্তম কুমারের মধ্যে, যার বিকল্প তার জীবদ্দশায় আর আসেনি। নায়ককে ঘিরে যে মোহ বিস্তার, যে গুঞ্জরণ, যে কৌতূহল সবই শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালের সেই সন্ধিক্ষণ থেকে।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে উত্তম কুমার ক্রমেই দর্শক, প্রযোজক, পরিবেশক এবং পরিচালকদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে লাগলেন। এভাবেই বক্স অফিসের নিশ্চিত গ্যারান্টিও হয়ে উঠলেন তিনি। তিনি শুধু বাংলা ছবির অন্যতম নায়কই নন, চরিত্রাভিনেতাও। বহু বাংলা ছবিকে ভরাডুবি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন শুধু উত্তম কুমার। শুধু প্রণয়ী নায়কের ভূমিকাতেই তিনি স্থিত থাকেননি, তিনি মদ্যপ জমিদার থেকে ছিঁচকে চোর—বহু ভূমিকাতেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন চরিত্রের মাপে।
চলচ্চিত্রের নায়ক উত্তম কুমার পর্দার বাইরেও কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন আপামর জনসাধারণের মধ্যে। সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সুদর্শন পুরুষ অথবা রোমান্টিকতার সার্থক উদাহরণ ছিলেন উত্তম কুমার। নায়ক শব্দের আগে ‘মহা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে। এটা কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। জনসাধারণের ভালোবাসা আর মুগ্ধতা থেকেই এই শব্দটি জন্ম নিয়েছিল। ক্রমেই উত্তম কুমারের নামের পাশে এই বিশেষণটি স্থায়ী হয়ে গেল। ১৯৬৬ সালে সত্যজিত্ রায় ‘নায়ক’ লিখেছিলেন উত্তম কুমারকে ভেবেই। এভাবে বাংলা সাহিত্যেও অনেক গল্প এবং উপন্যাস লেখা হয়েছে উত্তম কুমারের কথা মনে রেখেই।
উত্তম কুমার বিয়ে করেন ১৯৫০ সালের ১ জুন পদ্ম পুকুরের বাসিন্দা গৌরী দেবীকে। একমাত্র ছেলে গৌতমের জন্ম ১৯৫১ সালে। মৃত্যুর দুই বছর আগে ১৯৭৮ সালে ছেলে গৌতমকে বিয়ে করিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে নাতনির জন্ম হলে তার নাম রাখেন নবমিতা। কয়েক বছর আগে নবমিতা ফিল্মে যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি সেভাবে আগাতে পারছেন না।
উত্তম কুমার মহানায়ক হিসেবে তিন দশক ধরে বাঙালি দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। এভাবে মাতিয়ে রেখে মোহাবিষ্ট করে রাখার ইতিহাসও একমাত্র এই উত্তম কুমারের। যে জন্য এখন পর্যন্ত সব বয়সের দর্শকই ঘরে বসে ডিভিডির বদৌলতে তার অভিনীত ছবিগুলো দেখে থাকেন। তার অভিনীত পথে হলো দেরী, শিল্পী, সাগরিকা, হারানো সুর, সপ্তপদী, অগ্নিপরীক্ষা, শহরের ইতিকথা, পৃথিবী আমারে চায় প্রভৃতি যে চিরকালের চিরদিনের ছবি হয়ে থাকল।

জুন ১৫, ২০১১

স্বর্ণযুগের কণ্ঠশিল্পী মান্না দে

ক্যাপশন যুক্ত করুন
প্রায় নব্বইয়ের কাছে বয়স এখন মান্না দে’র। এ পর্যন্ত তিনি গেয়েছেন সাড়ে তিন হাজার গান। স্ত্রীসহ থাকেন ভারতের কর্নাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে। এ বয়সেও রোজ ঘড়ি ধরে ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর রেওয়াজে বসে যান। সে পর্ব চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। রেওয়াজ থেকে উঠে টুকটাক ঘরের কাজ করেন। বাংলা, ইংরেজি সব ধরনের পত্র-পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। খুব আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট, ফুটবল, গলফ খেলাও দেখেন। প্রতিদিন দুপুরে ঘুমান। বিকালে অনুষ্ঠান না থাকলে তিনি গান নিয়ে বসেন। এ বয়সেও গান ছাড়া তিনি যেন কিছুই বোঝেন না।
‘তুমি আর ডেকো না পিছু ডেকো না আমি চলে যাই, শুধু বলে যাই তোমার হৃদয়ে মোর স্মৃতি রেখো না আঁখিজল কবু ফেল না...’ এই গান কোথাও বেজে উঠলে পথচলা লোকজন এখনও থমকে দাঁড়ান। তাদের যে শুনতে হবে পুরো গানটি। শুনতেই যে হবে—‘নিবিড় আঁধারে একা নিবু দ্বীপ আর জ্বেল না পথ আর চেয়ে থেকো না/জানি মোর কিছু রবে না তোমার আমার দেখা এ জীবনে আর হবে না—আমার এ চলে যাওয়া চেয়ে দেখো না, অকারণে ব্যথা পেয়ো না হারালে যাহারে আজ তারে আর ফিরে চেয়ে দেখো না। বেদনায় হাসিতে ডেকো না পিছু ডেকো না।’... গানের এ কথাগুলোও।
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে। পিতা পূর্ণচন্দ্র দে তিন ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন বড়। মধ্যম হেমচন্দ্র দে আর মান্না দে’র কনিষ্ঠ কাকা হলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে। মান্না দে’র মাতার নাম মহামায়া দেবী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে মান্না দে পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। বড় ভাই প্রণব দে এক সময় বাংলার অন্যতম প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। দ্বিতীয় ভাই প্রকাশ চন্দ্র দে একজন চিকিত্সক ছিলেন। ছোট ভাই প্রভাষ চন্দ্র দে গান-বাজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তাদের মধ্যে মান্না দে বেশি নামধাম করেছেন। শৈশব জীবন তার কেটেছে কলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকেই আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কাকা কৃষ্ণচন্দ্রই মান্না দে’র সঙ্গীতানুশীলনে প্রথম প্রেরণা। সঙ্গীত পরিবারে জন্ম বলেই পরিবেশ ও জন্মগত প্রতিভা মান্না দেকে সঙ্গীতানুশীলনে এক সময় কৃতকার্যতার পথে নিয়ে যায়। প্রথম দিকে তার বাবা ও কাকা ছেলেদের কোনো দিনই সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় যোগদান করার অনুমতি দিতেন না। কিন্তু সমবয়সী অনেককেই বিচিত্রানুষ্ঠানে বিভিন্ন পদকে পুরস্কৃত হতে দেখে মান্না দে খানিকটা মনে মনে আঘাত পেতেন। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগদান করে যখন পুরস্কার পেলেন তখন খুশিতে মন ভরে ওঠে। সেটা ছিল ১৯৩২-৩৩ সালের কথা। ১৯৩৭ সালে মান্না দে ইন্টার কলেজিয়েট সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত থেকেও পদক নিয়েছিলেন। সঙ্গীতে তার হাতে খড়ি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের হাতে। ১৯৪১ সালের ২০ ডিসেম্বর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গে মান্না দে বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান। সেখানে গিয়ে কাকার সঙ্গে লক্ষ্মী প্রোডাকশনে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছবির নাম ছিল ‘তামান্না’ এবং ‘মেরা গাঁও’। পরে সঙ্গীত পরিচালক হরিপ্রসন্ন দাসের সহকারী হিসেবে ‘মহব্বত’ ও ‘কাদম্বরী’ ছবিতে কাজ করেন। এক সময় লক্ষ্মী প্রোডাকশন ত্যাগ করে ফিল্মস্থানে যোগ দিয়ে ‘মজদুর’ এবং ‘বেগম’ চিত্রে সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। পুনরায় লক্ষ্মী প্রোডাকশনে যোগদান করেন এবং ‘বীরাঙ্গনা’ ও ‘সতীতোরান’ ছবিতে সহকারী সঙ্গীত পরিচালকরূপে কাজ সম্পন্ন করলেন। ওই দুই ছবিতে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে গানও গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে শচীন দেব বর্মণের সহযোগী হিসেবে ‘মশাল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রথম ফণী মজুমদার পরিচালিত ‘তামান্না’ ছবিতে (১৯৫০ সালে) সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়া ‘গণেশ জনম’, ‘সুখ রম্ভা’, ‘শিব কন্যা’, ‘জয় মহাদেব’ প্রভৃতি ছবিরও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মান্না দে।
‘রাম রাজ্য’ ছবিতে (১৯৪৯ সালে) মান্না দে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এই ছবিতে তিনি ৭টি গান করে ছিলেন। বিশেষ করে বাল্মীকির গানগুলো। বিক্রমাদিত্য, অমরভূপালি, মা, দো বিঘা জমিন, পরিণীতা, সুরঙ্গ, ঝনক ঝনক পায়েল বাজে, আওয়ারা, বুটপালিশ, মহাত্মা, সীমা, হামদরদ প্রভৃতি হিন্দি ছবিতে মান্না দে’র গানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে মান্না দে বিয়ে করেন সুলোচনা দেবীকে। তিনি অবাঙালি হলেও মান্না দে’র জন্য কোনো অসুবিধা হয়নি। আজ অবধি তারা সুখের সংসার করে যাচ্ছেন। এখনকার গান সম্পর্কে মান্না দে’র অভিমত—‘এখন গান নিয়ে ছ্যাবলামো চলছে। যারা গাইছেন, তাদের কোনও শিক্ষাদীক্ষা নেই। গলায় সুর নেই। তাই এসব গান মর্মস্পর্শী হয় না।’ সঙ্গীতকে ভালোবাসেন এমন যে কেউ বলবেন, তার এ মন্তব্য যথার্থই। যে জন্য এখনও শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন মান্না দে’র গাওয়া ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ কিংবা হেমন্তের আকাশ আজি মেঘলা’, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘রানার রানার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ আরও কত কী সব কালজয়ী গান।

মে ১৪, ২০১১

রুনা লায়লা

লাহোরের ফিল্মের গানে তখনও খ্যাতির তুঙ্গে নূরজাহান, সেই ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। তখন রুনা লায়লার বয়স বছর পনের হবে। উঠতি বয়সে উর্দু ও পাঞ্জাবি ছবির গানে কণ্ঠ দেয়া সবে শুরু। ফিল্মের গানে হঠাত্ জড়িয়ে অল্পদিনের মধ্যেই তোলপাড় সৃষ্টি করলেন। ধীরে ধীরে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত। সেই ক্ষণে ১৯৬৮ সালে ঢাকার সুরকার সুবল দাস রুনা লায়লাকে দিয়ে প্রথম ‘স্বরলিপি’ ছবিতে গান করালেন। গানটি ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে।’ ডুয়েট এ গানের অপর শিল্পী ছিলেন মাহমুদুন্নবী। এ কথা তো আজ ইতিহাস। এই গানের সুরকার সুবল দাস আর কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবী আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন রুনা লায়লা। আজও রুনা লায়লা সমানে গান গেয়ে চলছেন। ফিল্মে, স্টেজে, চ্যানেলে এমনকি বিদেশে। গাইছেন তো গাইছেনই। ঈশ্বর প্রদত্ত এ কণ্ঠের প্রশংসা করেছিরেন এক সময় সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানও।
শত শত কালজয়ী গান গেয়ে রুনা লায়লা এখন কিংবদন্তি। রুনা লায়লার সঙ্গীত জীবন শুরু হয়েছিল করাচি থেকে। তখন তার বাবা ওখানে চাকরি করতেন বলে করাচি ও লাহোরে তাকে অনেক বছর থাকতে হয়েছিল। উর্দু ছবিতে যখন গান গাওয়া শুরু করেন তখন নূরজাহান প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে খ্যাতির শীর্ষেই ছিলেন। নূরজাহান মারা যাওয়ার আগে করাচিতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন রুনা লায়লা। তার কাছ থেকে রুনা লায়লা মায়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছিলেন। সে কথা এতদিন বাদেও তিনি সম্ভবত ভোলেননি। ভোলার কথাও নয়। কেননা রুনা লায়লার খ্যাতি প্রথম করাচি ও লাহোর থেকে শুরু হয়েছিল।
১৯৭৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রুনা লায়লা ঢাকার বাংলা গানে এক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, সেই সাম্রাজ্য আজও টলেনি। কত শিল্পী এলেন-গেলেন, কতজনই তো আছেন। কিন্তু একজন রুনা লায়লা কি সৃষ্টি হয়েছেন? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। একটা সময় ছিল, ঢাকার ফিল্মের গানে রুনা লায়লা একচ্ছত্র রাজত্ব করেছিলেন। এখনও সমানে চলছে রুনা লায়লার যুগ এবং আজ পর্যন্ত চিত্রগীতি ধারাবাহিকতায় তিনিই চূড়ান্ত উত্কর্ষের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। ফিল্মের লোকজন রুনা লায়লাকে দিয়ে এক সময় একচেটিয়া গান করিয়েছিলেন। রুনাকে দিয়ে বেশি গান গওয়ানো হয় কেন? এ প্রশ্ন তুলতেই একবার সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক ও সুরকাররা একবাক্যে বলেছিলেন, ‘কম সময়ের মধ্যে তিনি গান সম্পন্ন করে দিতে পারেন। তাকে একবার বুঝিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার সুর বোঝাতে হয় না। যার জন্য রুনা লায়লাকে দিয়ে বেশি গান করাই। তার কণ্ঠের যে তুলনা নেই।’
রুনা লায়লার জন্ম ১৯৫২ সালে। প্রথম দিকের পাঁচ বছর বাদ দিলে দেখা যাবে তিনি ৫৪ বছর ধরে সঙ্গীত সাধনায় নিমগ্ন। তিনি সর্বদাই সঙ্গীতের ধ্যানে মগ্ন। লাখো লাখো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে তিনি এগিয়ে আছেন। দেশ থেকে দেশান্তরে গান গেয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র রুনা লায়লার গান শোনার জন্য এখনও যে দর্শকদের বিনিদ্র রজনী কাটে। সঙ্গীতের প্রতি অসাধারণ অনুরাগ ও নিষ্ঠার জন্য তিনি পরিবার থেকেও উত্সাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কণ্ঠশিল্পী হওয়ার জন্য মা-বাবা দু’জনই তাকে উত্সাহ দিয়েছিলেন।
অল্প বয়স থেকেই স্টেজে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনি। পাশাপাশি করাচি রেডিওতেও গান গাইতেন রুনা। সঙ্গে থাকতেন তার মা। ১৯৬৬ সালের দিকে সিনেমার গান গাওয়ার জন্য মায়ের সঙ্গে করাচি থেকে লাহোরে যেতেন। ১৯৬৭ সালের কথা। ‘দাইয়ারে দাইয়ারে দাইয়া’ গানটি গেয়ে করাচি, লাহোর, কোয়েটা, পেশোয়ারে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকার লোকজনও তার গান শুনে এক সময় জানতে পারল, রুনা লায়লা যে বাঙালি মেয়ে। অল্পদিনের মধ্যে নজরুল ইসলামের ছবি ‘স্বরলিপি’ মুক্তি পাওয়ার পর সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল রুনা লায়লারই গাওয়া ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে।’ এভাবে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল তার নামধাম। অবশ্য এর আগেই ‘জুগনু’ ছবিতে মনজুর হোসেনের সুরে ‘গায় ছে মুন্নি ছে’ গেয়ে লাহোর ও করাচিতে তার জনপ্রিযতা শুরু হয়েছিল। নিসার বাজমির সুরে ‘নায় না তারাশ কে রেহে গায়া’ এবং সোহেল রানার সুরে ‘হ্যায় মেরি হিয়ে দোয়া তুম সালামাত রাহো’ গান দুটি তার জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রুনা লায়লা নিজেকে শুধু সঙ্গীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১৯৯৭ সালের ১৬ মে রুনা লায়লা নায়িকা হিসেবে ‘শিল্পী’ ছবিতে আলমগীর, দোদুল ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন। রুনা লায়লার ব্যক্তিগত জীবন ঘিরে ‘শিল্পী’ ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছিল। লাহোরের উর্দু ছবিতে রুনা লায়লার গান সফল হয়েছিল চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন ও অডিওতে এ পর্যন্ত তিনি ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার গাওয়া শ্রোতানন্দিত উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে—‘অনেক বৃষ্টি ঝড়ের পরে তুমি এলে’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’, ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’, ‘বুকে আমার আগুন জ্বলে’, ‘যাদু বিনা পাখি’, ‘একটু খানি দেখ একখান কথা রাখ’, ‘আইলো দারুণ ফাগুনরে’, ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল’, ‘পাহাড়ি ফুল আমি মৌরানী’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’, ‘আমার অনেক ঋণ আছে’ প্রভৃতি আরও কত কী সব! তিনি একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক মেয়েসন্তানের জননী। মেয়ে তানি লায়লাও একজন সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী।

মে ০৪, ২০১১

ব্যান্ড সঙ্গীতের গুরু আজম খান

ব্যান্ড সঙ্গীত তারকাদের গুরু হলেন আজম খান। বাংলাদেশে পপ গানের পথিকৃত্ তিনিই। ‘ওরে ছালেকা ওরে মালেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে’, ‘আলাল কই দুলাল কই’ ইত্যাদি গান দিয়ে তিনি আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে আছেন। আজম খানের পথ ধরেই পরে এসেছেন হামিন, শাফিন, মাকসুদ, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, বিপ্লব এবং আরও অনেকে। এরা সবাই আজম খানকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। একটা সময় গেছে যখন তাকে একাই শুধু রাতের পর রাত পপ গান গাইতে হয়েছে। তাই পপ গুরু বলা হয় এই আজম খানকে।
১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আহার-নিদ্রা ভুলে গিয়ে তাকে একের পর এক স্টেজ শো করতে হতো। সেই দিনগুলোয় লাখ লাখ জনতা আজম খানকে একনজর দেখার জন্য স্টেজে কিংবা পথে-ঘাটে ভিড় করত। সেই জনতা আজ কোথায়? থাকলেও হয়তো নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো আজম খানকে দেখার সময় যে তাদের হাতে নেই। আজম খান বিদেশে বহুবার গেছেন। ১৯৮৬ সালে বাহরাইন, ১৯৯৩ সালে আমেরিকা এবং ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্টেজ শো-তে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি যে ধরনের গান গাইতেন তা হলো পপ আর ব্যান্ড সঙ্গীত। তার সৃষ্টি করা গান এখন জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, বিপ্লবরা গাইছেন। আজম খানের মতে, ব্যান্ড শিল্পীরা মূলত পপ গানই গাইছেন। মডার্ন মিউজিককে প্রাধান্য দিয়েছিলাম বলেই পপ সঙ্গীতে এসেছিলাম। মন আর দেহ দুটোকেই নাড়া দেয় পপ সঙ্গীত। এ সঙ্গীতে গানের সঙ্গে নাচও করতে হয়। পপ আর ব্যান্ড সঙ্গীত যে একই।
আজম খানের আসল নাম মাহাবুবুল হক খান। ডাকনাম আজম। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর কলোনির ১০ নম্বর বিল্ডিংয়ে। এসএসসি পাস করেন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমিল্লা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার। আজম খানের আদিবাড়ি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলায়। তার প্রথম অ্যালবাম বের হয় ১৯৮২ সালে।
তার জীবনে বহু স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও খুলনায় বহু স্টেজ শো করেছেন তিনি। ময়মনসিংহের একটি ঘটনা প্রায়ই তার মনে নাড়া দেয়। ময়মনসিংহের এক কলেজে স্টেজ প্রোগ্রাম করার জন্য গিয়ে দেখলেন হাজারও জনতার ভিড়। তখন দুপুর। যেখানে স্টেজ করা হয়েছিল তারই আশপাশে ছিল কয়েকটি বিল্ডিং। মাঠে পাবলিক ধরছে না বলে বিল্ডিংয়ের ছাদে ও গাছে বসে দাঁড়িয়ে পাবলিক এনজয় করে যাচ্ছিল। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে উঠতি বয়সের অনেক ছেলে নৃত্যও করছিল। হঠাত্ আজম খান দেখলেন, ছাদ ভেঙে পড়ে গেল। বিকট আওয়াজে পড়ে যায়। তাদের ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আজম খান পরে জানলেন তাদের সবাই ব্যথা পেয়েছে, তবে কেউই মারা যায়নি। এ ঘটনাটির কথা মনে হলে এখনও আজম খানের খারাপ লাগে।
আজম খানের গানের সংখ্যা তিনশ’র মতো। গান করতে গিয়ে কখনও কারও কাছ থেকে বাধা পাননি। স্ত্রী শাহিদা বেগম এবং ছেলেমেয়েরাও তাকে উত্সাহ দিয়েছে। দেশাত্মবোধক গানও করেছেন তিনি। আসলে আজম খান প্রথমে গণসঙ্গীত করতেন—এটাই ছিল তার মৌলিক দিক। তিনি সব সময় দুঃখী মানুষের জন্যই গান করেছেন। একটা সময় রটে গেল আজম খান নাকি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সেটা ছিল ১৯৮০ সালের কথা। পরে দেখা গেল তিনি সুস্থই আছেন। সেই সময় স্টেজ শো হলে পপ সঙ্গীত তাকেই গাইতে হতো। একবার আজম খান জানিয়েছিলেন, একটা সময় এসে দেখলাম মাইলস ইংরেজি গানই করত। তাদের বোঝালাম, ইংরেজি গান বাদ দিয়ে বাংলায় পপ গান কর। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত গান আর রিহার্সেল নিয়ে থেকে থেকে একপর্যায়ে অসুখে পড়ে গেলাম। পরে চিকিত্সকের কাছে গেলে তিনি সম্পূর্ণ রেস্ট নেয়ার জন্য বললেন। এ কারণেই সঙ্গীত ভুবন থেকে কিছুদিনের জন্য সরে দাঁড়ালাম। রক্তে সঙ্গীত মিশে ছিল বলেই আবার ফিরে এসেছিলাম সঙ্গীত ভুবনে।
আজম খানের সঙ্গীতে কোনো শিক্ষাগুরু ছিলেন না। কারও কাছে কোনো দিন গানও শেখেননি। ওস্তাদ ছাড়াই সঙ্গীত লাইনে এসেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, মোহাম্মদ রফি, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র, জগন্ময় মিত্র প্রমুখের গান শুনে শুনে গান শেখা শুরু করেন আজম খান। তার বাবা আফতাব উদ্দিন খানও গান শুনতেন—প্রচুর লং প্লে ছিল তাদের বাড়িতে। সবাই মিলে নিয়মিত গান শুনতেন। গান শুনতে শুনতেই গানের প্রতি তার দরদ জন্মায়। এভাবেই আজম খান একদিন ক্রান্তি সাংস্কৃতিকগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। সেটা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। এক সময় গণসঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গণসঙ্গীতও গাইতে শুরু করে দিলেন ঢাকা এবং এর বাইরে। গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। যুদ্ধ করলেন, দেশ স্বাধীনও করলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর সঙ্গীতে বিভোর হয়ে দেশজুড়ে পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীত ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন তিনি। এক সময় আজম খানের গাওয়া—‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে’ গানটা এতোই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এ গান গোটা বাংলাদেশের মানুষ যেন এক হয়ে গাইতে লাগল। এখনও এই গানের জনপ্রিয়তা কিন্তু থমকে যায়নি। ফিল্মেও তিনি গান করেছিলেন। ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’, ‘আরশী নগর’, ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’ প্রভৃতি ছবিতে তিনি গান করেছিলেন। তবে তার ভালো লাগত পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীত। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু আজ যা গাইছেন সেটা তারা দেখে দেখে আজম খানের কাছেই শিখেছিলেন। তাই বলতে হয় জেমস, বাচ্চু এবং এখনকার ব্যান্ড তারকাদের মহাগুরু হলেন আজম খান। বাংলাদেশের পপ কিংবা ব্যান্ড মিউজিকের পাইওনিয়ার হয়ে থাকবেন এই আজম খান।

এপ্রিল ২৭, ২০১১

নাট্যগুরু আসকার ইবনে শাইখ

আসকার ইবনে শাইখ একাধারে নাট্যকার, গীতিকার, সংগঠক, অভিনেতা, গাল্পিক, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাসৈনিক, ইতিহাসবেত্তা ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। পূর্ব-বাংলার মুসলিম সমাজজীবননির্ভর প্রথম নাটক ‘বিরোধ’ রচনা করেন তিনি। নাটকটি সে আমলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকের মধ্য দিয়ে আসকার ইবনে শাইখ পথিকৃত নাট্যকারের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
আসকার ইবনে শাইখের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। আসকার ইবনে শাইখ তার লেখক নাম এবং এ নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। শাইখের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ মার্চ মোমেনশাহী জেলার গৌরীপুর থানার মাইজহাটি গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই নাটকের প্রতি ছিল তার দুর্দমনীয় আকর্ষণ। শাইখ মোমেনশাহী জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি জড়িত হন ভাষা আন্দোলনের পথিকৃত সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে। এ সংগঠন থেকে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের পাশাপাশি প্রকাশ হতো মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্যুতি’। এ পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন আসকার ইবনে শাইখ। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর।
পেশায় শিক্ষক হলেও নাটকের নেশায় তিনি ছিলেন সারাজীবন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এদেশের আধুনিক নাট্যজগতের ভিত্তিভূমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন আসকার ইবনে শাইখ। নাটক রচনা, নাট্য সংগঠন পরিচালনা, নির্দেশনা, অভিনয়সহ নাটকের সব ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরণ। মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা সব মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। পূর্ববাংলার গণমানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল আসকার ইবনে শাইখের নাটক। জননেতা মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন তিনি। মওলানা ভাসানী আসকার ইবনে শাইখের নাটককে মূল্যায়ন করতেন ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। যে জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল সে জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্রই পরিদৃষ্ট ছিল শাইখের নাটকে। ফলে মওলানা তাকে দেখতেন গণমানুষের জীবনের রূপকার হিসেবে।
আসকার ইবনে শাইখ রচনা করেছেন বিপুল সংখ্যক নাটক। শুধু সামাজিক নয়, এদেশের মানুষের গোটা ইতিহাসকেও তিনি রূপান্তর করেছেন তার নাট্যকর্মে। আজও অনবদ্য অক্ষয় হয়ে আছে তার কীর্তি ‘রাজ্য-রাজা-রাজধানী’। এদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসও হয়ে উঠেছে তার নাটকের উপজীব্য, লিখেছেন ‘কন্যা-জায়া-জননী’। এ দুটি বিশেষ নাট্যক্রম বাংলা নাটকের ইতিহাসে পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এছাড়াও তার নাটক পদক্ষেপ (১৯৪৮), বিদ্রোহী পদ্মা (১৯৪৮), দুরন্ত ঢেউ (১৯৫১), শেষ অধ্যায় (১৯৫২), অনুবর্তন (১৯৪৩), বিল বাঁওড়ের ঢেউ (১৯৫৫), এপার ওপার (১৯৫৫), প্রতীক্ষা (১৯৫৭), প্রচ্ছদপট (১৯৫৮), লালন ফকির (১৯৫৯), অগ্নিগিরি (১৯৫৮), তিতুমীর (১৯৫৭), রক্তপদ্ম (১৯৫৭), অনেক তারার হাতছানি, (১৯৫৭), কর্ডোভার আগে (১৯৮০), রাজপুত্র (১৯৮০), মেঘলা রাতের তারাসহ (১৯৮৭) অধিকাংশ নাটকই ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘদিন তিনি তার নিজবাসায় একটানা নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজটি করেছেন একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। যার ফলে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন। আসকার ইবনে শাইখ পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যকার, অভিনেতা ও কলা-কুশলীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি কিংবদন্তি নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক ‘বাসন’ও সাক্ষ্য দেয় সেলিম কীভাবে শাইখের উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছেন। শাইখ তার মেধা-প্রতিভা, সৃজনক্ষমতা ও দায়বোধের প্রকাশ এমনভাবে ঘটিয়েছেন যে, সেই পঞ্চাশের দশক থেকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে তিনিই ছিলেন এদেশের নাট্যগুরু। এই সর্বজন স্বীকৃত নাট্যগুরু ইন্তেকাল করেন ২০০৯ সালের ১৮ মে রাজধানীতে তার নিজ বাসভবনে।
এদেশের মুসলিম সমাজজীবনে বিশেষ করে নগরকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষিত একশ্রেণীর সংস্কৃতিসেবীর ওপর সেকুলারিজমের ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এক সময় ধীরে ধীরে আসকার ইবনে শাইখ নামটি আড়ালে পড়ে যায়। কেননা সেকুলাররা মনে করেন শাইখের নাম উচ্চারিত হলেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছুটে আসবে। ফলে মৃত্যুর পূর্বে প্রায় দেড়-দুই দশক তিনি অনেকখানি অন্তরালে চলে যান। কিন্তু তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সে ইতিহাস জীবদ্দশায়ই তাকে পরিণত করে কিংবদন্তিতে। বর্তমানে তার নাটক ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তেমন কোনো তত্পরতা না থাকলেও এটা অসম্ভব নয় যে, এদেশের জনগণ একদিন তার সৃষ্টিকর্মকে নবজাগরণের হাতিয়ার বানিয়ে তুলবে এবং যে মহত্ তত্পরতায় তিনি তুলে এনেছেন জীবন ও ইতিহাসের বিচিত্র দৃশ্যাবলী তার যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

এপ্রিল ২২, ২০১১

ফার্স্ট লেডি সুমিতা দেবী

ঢাকার ছবির প্রথম দিককার নায়িকা হলেন সুমিতা দেবী। সুমিতা দেবী অভিনীত ‘আকাশ আর মাটি’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই। এই ছবিটি তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে প্রথম। তবে তিনি ‘আসিয়া’ ছবিতে প্রথম কাজ শুরু করেন। ‘আসিয়া’য় তার নায়ক ছিলেন শহীদ। ১২টির মতো ছবিতে সুমিতা নায়িকা ছিলেন। তাকে বলা হয় ঢাকার ফিল্মের প্রথম ফার্স্ট লেডি। ফিল্মে যোগ দিয়ে তার নাম হয়েছিল সুমিতা দেবী। আসল নাম তার ‘হেনা’। ১৯৩৫ সালে ঢাকার মানিকগঞ্জে তার জন্ম। ১৯৪৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে হেনা ঢাকায় চলে এলেন। এসেই বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে হেনা পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে কিছুদিন ছিলেন, এরপর কলকাতায় ফিরে আসতেই হেনার বিয়ে হয়ে গেল অতুল লাহিড়ির সঙ্গে। হেনা থেকে হয়ে গেলেন হেনা লাহিড়ি। ওদের এ বিয়ে বেশিদিন টিকল না। ১৯৫৭ সালে হেনা ফিরে এলেন ঢাকায়। এদিকে ঢাকায় ছবি নির্মাণ হচ্ছে শুনে হেনার ইচ্ছে জাগল তিনিও ফিল্মে অভিনয় করবেন। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে এ ছবিতে তার অভিনয় করা সম্ভব হয়নি। পরে ওই চরিত্রটি করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে তৃপ্তি মিত্র। ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ ছবিতে হেনা নাম পাল্টিয়ে ‘সুমিতা দেবী’ নামে প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন তিনি। তবে ‘আসিয়া’ রিলিজের আগেই নায়িকা সুমিতা দেবীর ‘আকাশ আর মাটি’ এবং ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে তার দুই নায়ক ছিলেন। তারা হলেন—আমিন ও প্রবীর কুমার। ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে সুমিতার বিপরীতে ছিলেন আনিস। এ ছবি দুটিতে সুমিতা ও আনিস বিভিন্ন রোমান্টিক দৃশ্যে অংশ ছাড়াও কয়েকটি গানের দৃশ্যে ছিলেন। মাহাবুবা রহমানের গাওয়া সুমিতা দেবীর লিফে—‘নয়নে লাগলো যে রঙ আহা তা কেউ জানলো না’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতেই ছিল এই গানটি। ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়। নায়ক ছিলেন শহীদ। আসিয়া ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের গাওয়া—‘মেঘে দেওয়ায় করছে মেঘলী তোলাইল পূবাল বাও’ গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। ছবিতে তার প্রেমিক শহীদ। কিন্তু ছবির কাহিনী অনুযায়ী শহীদের চাচা কাজী খালেকের সঙ্গে সুমিতার বিয়ে হয়। প্রেমিকা সুমিতা হয়ে গেলেন প্রেমিক শহীদের চাচী। এটা দুজনে মেনে নিতে পারেননি। যে জন্য শেষতক ওদের সহমরণ হয়েছিল। নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবীর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আরও রয়েছে—সোনার কাজল (১৯৬২, নায়ক খলিল), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩, নায়ক আনোয়ার হোসেন), এই তো জীবন (১৯৬৪, নায়ক রহমান), দুই দিগন্ত (১৯৬৪, নায়ক আনোয়ার হোসেন), ধূপ ছাঁও (১৯৬৪, নায়ক এজাজ), জনম জনম কি পিয়াসি (১৯৬৮), সঙ্গম (১৯৬৩, নায়ক খলিল), অশান্ত প্রেম (১৯৬৮, নায়ক হায়দার শফী)। এ দেশ তোমার আমার ছবি সম্পর্কে সুমিতা দেবী তার জীবদ্দশায় জানিয়েছিলেন, এ ছবির সবচেয়ে সার্থক অংশ হলো সঙ্গীত। আমার সহশিল্পী দাগু বর্ধন জমিদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি প্রতিটি দৃশ্যে আশ্চর্য অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। নায়ক আনিস বিশেষ করে তার দীপ্ত মুখখানা এখনও আমার চোখে ভাসে। অভিনয় গুণে তিনি নায়ক চরিত্র সার্থক করেছিলেন। সুভাষ দত্ত, রহমান, মেসবাহ প্রমুখ অভিনেতাও ‘এ দেশ তোমার আমার ছবিতে ছিলেন। রহমান ছিলেন খলনায়ক। বাঙালি মেয়ে সুমিতা দেবী এক সময় ঢাকা থেকে লাহোরে গেলেন উর্দু ছবিতে অভিনয় করার জন্য। অবশ্য তার আগে সাতক্ষীরার মেয়ে স্মৃতি রেখা বিশ্বাস লাহোরের ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। লাহোরে গিয়ে সুমিতা ‘ধূপছাঁও’ ছবিতে অভিনয় করেন। ওই ছবিতে তার নায়ক ছিলেন নায়িকা-গায়িকা নূরজাহানের স্বামী এজাজ। ‘ধূপছাঁও’ ছবিটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে সুমিতা দেবী নায়িকা চরিত্র ছেড়ে দিয়ে মা, খালা, ভাবীর চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৯ সালের শেষদিকে ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে তারা একে অপরকে মন দিয়ে বসলেন। তারপর দু’জনে গোপনে কোর্টে গিয়ে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তারা প্রায় ৮ বছর ধরে সুখের সংসার করেন। এরপর তার স্বামী জহির রায়হান আবারও বিয়ে করার কারণে সুমিতা দেবীর জীবনে দুঃখ নেমে আসে। সুমিতা দেবী কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মায়ার সংসার, আদর্শ ছাপাখানা, নতুন প্রভাত, আগুন নিয়ে খেলা, মোমের আলো প্রভৃতি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় থাকাকালীন সুমিতা দেবী উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘শ্রী শ্রী সত্য শাহী বাবা’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন। ৮০ ভাগ শুটিং শেষে ছবির কাজ আর হলো না। সুমিতা দেবী মারা যান ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি। ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘আকাশ আর মাটি’, ‘এই তো জীবন’ প্রভৃতি ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করে সুমিতা দেবীও কিংবদডিন্ত হয়ে রইলেন।

আনোয়ার হোসেন : সিনেমার মুকুটহীন সম্রাট

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার পর আনোয়ার হোসেন যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানেই দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে গেলেন একবার। এক লোক দৌড়ে এসে বললেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১২ বার দেখেছি। নওগাঁর এক লোক বললেন, ৫০ বার নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেখে ছেলের নাম রেখেছি—‘আনোয়ার হোসেন’। হাইকোর্ট মাজারে গেলেন আনোয়ার হোসেন। এক রিকশাওয়ালা মালা কিনে তার গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার জীবন আজ সার্থক হয়েছে। লাহোরে এক ছবির শ্যুটিং করার জন্য গেলেন তিনি, সেখানে এক চাষী হাল ছেড়ে সোজা দৌড়ে এসে আনোয়ার হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাঙাল কা নওয়াব বাঙাল কা নওয়াব’। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিটির মাধ্যমে তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন। বাঙালি চিরদিন তাকে বলবেন—এ যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালে জামালপুরের সরুলিয়া গ্রামে। পিতা নাজির হোসেন ছিলেন জামালপুরের সাব-রেজিস্ট্রার। শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বেশ ক’বছর কেটেছে তার জামালপুরে। ১৯৫১ সালে জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে মঞ্চ নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। রাতভর মঞ্চে হিরোর পাঠ করতেন। ময়মনসিংহ ছেড়ে একসময় ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকা বেতারের নাটকে প্রথম অভিনয় শুরু ১৯৫৭ সালে। নাটকটির নাম ছিল নওফেল হাতেম’। আনোয়ার হোসেন অভিনীত প্রথম ছবি—‘তোমার আমার’। মহিউদ্দিন পরিচালিত এ ছবিতে তিনি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মোঃ আনিস নামে তখনকার এক ফিল্মের সহকারী পরিচালক তাকে প্রথম ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ‘সূর্যস্নান’ তার দ্বিতীয় ছবি। এটি মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। এরপর অভিনয় করলেন— জোয়ার এলো (১৯৬২), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), নাচঘর (১৯৬৩), দুই দিগন্ত (১৯৪৬), বন্ধন (১৯৬৪), একালের রূপকথা (১৯৬৫) প্রভৃতি ছবিতে। ‘দুই দিগন্তে’ তাঁর নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী। ১৯৬৪ সালের ১ মে ‘দুই দিগন্ত’ ছবিটি দিয়ে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহের শুভ উদ্বোধন হয়েছিল। রোজির সঙ্গে ওই সময় বন্ধন, একালের রূপকথা ছবি দুটিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে সাতরং (উর্দু ছবি) ছবিতে ট্রাক ড্রাইভার চরিত্রে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। নায়িকা সুলতানা জামান তার ট্রাকে এসে আশ্রয় নেন। ওকে ছোট বোন হিসেবে গ্রহণ করলেন। পরে হারুনের সঙ্গে সুলতানা জামানের বিয়ে দিয়ে একখানা কোরআন শরীফ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজা সন্ন্যাসী’ ছবিতে তাকে সন্ন্যাসী প্রশান্তের চরিত্রে অভিনয় করে ধূতি পরতে হয়েছিল। সন্ন্যাসী সেজেছিলেন সুজাতা। ছবিতে সুজাতাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন তিনি। এরপর উর্দু ছবি ‘উজালা’য় নায়ক হিসেবে অভিনয় করলেন। তার নায়িকা ছিলেন সুলতানা জামান। ‘উজালা’ মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে বাংলা ও উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে কাজ করার পর আনোয়ার হোসেনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছবির চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেই সারা বাংলাদেশের লোকজন তাকে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ বলে চিনতে-জানতে শুরু করল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এরপর ‘অপরাজেয়’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা ছিলেন সুজাতা। ‘পরশমণি’তে সাহিত্যিক হিসেবে অভিনয় করেন। ‘শহীদ তিতুমীর’ এবং ‘ঈশা খাঁ’ ছবি দুটিতে তিনি নাম ভূমিকায় ছিলেন। ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’ ছবির শ্যুটিং করার জন্য ১৯৬৭ সালে লাহোরে গেলেন। ছবিতে তিনি রাজার ভূমিকায় ছিলেন। ‘জাহা বাজে শেহ্ নাই’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। নায়ক হিসেবে তার শেষ ছবি ‘সূর্য সংগ্রাম’। নায়িকা ছিলেন রোজি। ১৯৬৭ সালে ‘রাখাল বন্ধু’তে ছিলেন রাজা। আবির্ভাবে ডাক্তার। ‘তুম মেরে হোতে’ চরিত্রাভিনেতা, ‘গৌরীতে’ খলনায়ক, ‘এতটুকু আশা’য় রোজির নায়ক ছিলেন তিনি। গৌরীতে উপজাতিদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছেন তিনি। নায়ক-নায়িকা ছিলেন রহমান ও নাসিমা খান। ‘পালঙ্ক’ তার জীবনের এক স্মরণীয় ছবি। রাজেন তরফদার পরিচালিত ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। তার অসাধারণ অভিনয় দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিল। শুধু কি তাই, বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত্ রায় ‘পালঙ্ক’ ছবিতে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই তো ক’বছর আগেও আনোয়ার হোসেন বাবা, দাদা, চাচা ইত্যাদির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অসুস্থতা ও বয়সের কারণে এখন আর তিনি অভিনয় করতে পারছেন না। বহু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেলেন ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫) ছবির জন্য। ওই ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তে সহ-অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেলেন ১৯৭৮ সালে। এরও আগে ১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’য় অভিনয় করে নিগার পুরস্কার পেয়েছিলেন। অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই ১৯৮৮ সালে প্রথম একুশে পদক পান।

এপ্রিল ২১, ২০১১

ফেরদৌসী রহমান সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী

ফেরদৌসী রহমানের গান এক সময় বাংলা ছবিতে শুধু জনপ্রিয়তা ও সাফল্যই দেয়নি, দিয়েছিল এক ধরনের সুরমগ্ন মাদকতাও। ‘মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছিনু নিতে’, ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার’, ‘বিধি বইসা বুঝি নিরালে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘মনে হলো যেন এই নিশি লগনে’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে এক সময়ে তার জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল প্রায় অচল। ফিল্মে গান করা ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হয়। অথচ তার গাওয়া অতীতের সেই সব গান আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে থাকল। আর এ জন্য সঙ্গীত ভুবনে ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তি। জন্ম তার ১৯৪১ সালের ২৮ জুন। সে হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের বয়স প্রায় সত্তর। এ বয়সে তিনি মাঝে মধ্যে সঙ্গীতবিষয়ক আলোচনা সভা, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সঙ্গীত সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবেও তিনি উপস্থিত হচ্ছেন হঠাত্ হঠাত্। ফেরদৌসী বেগম ১৯৪৬ সাল থেকে বেতারে গান করা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। একটু বড় হয়েই রেকর্ডে—‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’ গান খানি গাইলেন। এই গান দিয়েই তিনি বাঙালি শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেলেন। সিনেমার গানে প্রথম কণ্ঠ দেন ১৯৫৮ সালে ‘আসিয়া’ ছবিতে। তবে ‘আসিয়া’ ছবিটি একটু বিলম্বে মুক্তি পাওয়ার কারণে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘এ দেশ তোমার আমার’। এটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এ ছবিতে ফেরদৌসী বেগম গেয়েছিলেন, ‘চুপিসারে এত করে কামিনী ডাকে’ গানখানি। ফেরদৌসী রহমান ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফিল্মে যেসব গান করেছেন তার সবগুলো আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিন ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তার গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন। ফেরদৌসী বেগমের শিল্পী জীবনের একটি বিরাট সৌভাগ্য, তিনি এ দেশের গুণী অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল আহাদের সুর করা আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন। এছাড়া খন্দকার নুরুল আলম, আজাদ রহমান, জালাল আহমদ, আবদুল লতিফ, ওসমান খান, কানাইলাল শীল, আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ, সমর দাস, সুবল দাস, অজিত রায় প্রমুখ খ্যাতনামা সুরকারের সুরেও গান গেয়েছেন। প্রথম সুরকার হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে রবীন ঘোষও সুরকার হিসেবে ছিলেন। স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী বেগম ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘নোলক’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। আজকাল ফেরদৌসী রহমান তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাস উদ্দিন সঙ্গীত একাডেমির পেছনেও বেশ সময় দিচ্ছেন। এই একাডেমিকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গাওয়া গানগুলো তার মনে আগের মতোই নাড়া দেয়। শুধু তার অন্তরে নয়, এ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীরাও আবার গাইছেন আব্বাস উদ্দিনের গান। বিয়ের পরেই (১৯৬৬ সালে) ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তার দুই ছেলে রুবাইয়াত আর রাজন আজ প্রতিষ্ঠিত। ওরা যে যার সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এ বয়সে সময় পেলে বিদেশে ছেলেদের কাছে তিনি বেড়াতে যান। নবীন শিল্পীদের লোকসঙ্গীত গাইবার ব্যাপারে উত্সাহ দেয়া ছাড়াও শিশু-কিশোরদের বহু বছর ধরে তিনি গান শিখিয়ে আসছেন। এভাবেই একের পর এক কাজ নিয়ে ফেরদৌসী রহমান এখনও ব্যস্ত। বিদেশি গান গাইবার স্মৃতি এখনও তার মনে নাড়া দেয়। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান একবার জানিয়েছিলেন, ১৯৬৩ সালের কথা এখনও আমার বারবার মনে পড়ে। সে বছর আমি ও লায়লা আরজুমান্দ বানু দু’জনে একত্রে মস্কোয় গিয়ে গান করেছিলাম। এককভাবে এক অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম ‘ও মোর চান্দোরে ও মোর সোনারে’ গানটি। এ গান শেষ হতেই প্রচুর হাততালি শুরু হলো, আমি তো গান গেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু হাততালি থামছে না চলছেই। পরে লোকজন আমাকে টেনেটুনে আবার স্টেজে পাঠাল। তখন বুঝলাম এই হাততালি মানে আরও গান গাইতে হবে এবং তাই করলাম। চীনে গান গাইতে গেলাম ১৯৬৬ সালে। চৌ এন লাই তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী। তার সামনে গাইলাম ‘চুং ফাং হোং’ গানটা। এটি ছিল চীনা ভাষার গান। এ গান শুনে প্রধানমন্ত্রী আমার প্রশংসা করে বললেন, তুমি তো চীনা ভাষা জানো না। এতো দরদ দিয়ে গাইলে কীভাবে? তিনি বারবার আমার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। সেই কবেকার ঘটনা, যা আজও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। ফেরদৌস শব্দের অর্থ স্বর্গীয়। ফেরদৌসী শব্দের অর্থ ‘শ্রবণের স্বর্গ’। বাস্তবে অর্থাত্ শিল্পী জীবনেও তাই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তিনি এ দেশের সিনেমার গান প্রথম জনপ্রিয় করে গেছেন। সিনেমার স্বর্ণযুগের শিল্পী তিনিই। তার প্রতিটি গানই ফেরদৌসী রহমানকে স্মরণে আনবে দীর্ঘকাল।

নজরুল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

নানা রকম বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন সঙ্গীত সাধনা করে ফিরোজা বেগম শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয় হয়েছেন। আশির কোঠায় এখন তার বয়স। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরু থেকে তিনি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর প্রায় সাত দশক পার হলো। এখন তিনি অসুস্থ। এরই মধ্যে তার চিকিত্সার পেছনে কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। অথচ মস্তবড় এই শিল্পীর চিকিত্সার ব্যাপারে কোনো সংগঠন বা সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। এটা দুঃখজনক। এটা ফিরোজা ভক্তদের মনে দারুণ কষ্ট দিয়েছে। ফিরোজা বেগম মানেই বাংলার গৌরব। তিনি জীবদ্দশায় হয়েছেন কিংবদন্তি। তার মতো মস্তবড় শিল্পী আমাদের দেশে আর কোথায়? তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি আজীবন সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। অসুখ অবস্থায়ও তিনি সঙ্গীত নিয়ে ভাবেন। এ রকম কি আর কেউ ভাবেন? চিত্ত রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, কমল দাস গুপ্ত, সুধীর লাল চক্রবর্তী ছাড়া আরও অনেকে তার কাছে এখনও স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি। ‘বউ কথা কও, কও কথা অভিমানিনী’—গানের এ কথা মনে হলে ফিরোজা বেগমের নামটি হৃদয়ে বার বার জেগে ওঠে যে কোনো সঙ্গীতপ্রেমিকের হৃদয়ে। উঠবেই না কেন, তিনি যত গান গেয়েছেন তার সবই তো শ্রোতাদের মনে দাগ কেটে আছে। সে জন্য ফিরোজা বেগমের গাওয়া গানগুলো বার বার শুনেও লাখো শ্রোতার মনের পিপাসা যে মিটছে না। ১৯৪২ সাল থেকে ফিরোজা বেগমের গান গাওয়া শুরু। দীর্ঘ সময়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। একটা সময়ে এসে তিনি নজরুলের গানই বেশি গাইতে লাগলেন। গান গাইতে গিয়ে তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন। যে জন্য তিনি কত শত পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ফিরোজা বেগম নজরুলের গান করেন—এ কথাই শ্রোতারা বলেন বেশি। তিনি অডিও ক্যাসেট ও সিডিতে রবীন্দ্রনাথের গানও করেছেন। তিনি গেয়েছেন অতুল প্রসাদ ও রজনী কান্তের গানও। ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯২৮ সালে ফরিদপুরে। একটু বড় হয়ে গান গাওয়ার ব্যাপারে তার পিতার গান শোনার শখ এবং মাতার গলার সুর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। ফিরোজা যখন ছিলেন কিশোরী, তখন তার কণ্ঠে গান শুনে সঙ্গীত ভুবনের গুণীজনরা বলতেন—এই মেয়ের গলায় রেকর্ড হতে পারে, এ কথা শুনে তিনি চমকাতেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি রেকর্ডে ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কৃষক চন্দ্র দে’র গান শুনতেন তন্ময় হয়ে। কিশোরী বয়সে ফিরোজা বেগমের প্রতিভা শুধু গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাঁতার, খেলাধুলা, ক্লাসিক্যাল নাচ ও গানের ক্ষেত্রে অসাধারণ বিশেষত্বে বিকশিত হয়ে ওঠেন। নাচ ও গানের জন্য স্বয়ং গুরু সদর দত্ত নিজ হাতে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। একবার কিশোরী ফিরোজা বেগম শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে ৬টি গান পরিবেশন করে ফরিদপুর শহরে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেন। সে তো ১৯৩৭ সালের কথা...। ফিরোজা বেগম মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাত্ ১৯৩৯ সালে চলে গেলেন কলকাতায়। তার বড় বোন তখন কলকাতায় সংসার করছেন। সেখানে গিয়েই উঠলেন। বিরাট শহর, তাই কলকাতায় গিয়ে গান শেখার পূর্ণ সুযোগ পেলেন। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান সহকারী সুরশিল্পী চিত্ত রায়ের কাছে প্রাথমিক পাঠ নিতে শুরু করলেন। সেখানেই তার সঙ্গে বিশিষ্ট সুরকার কমল দাস গুপ্তের প্রথম দেখা হয়। চিত্ত রায় ও কমল দাস গুপ্তের সহযোগিতায় ১৯৪২ সালে তার প্রথম দুটি গানের রেকর্ড বের হলো। গান দুটি হলো—‘মরুর বুকে জীবন ধারা কে হারালো’ এবং ‘ঠ্যায়রো ঠ্যায়রো জ্যারা’। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তিনি নিয়মিত গান করেছেন, যেমন—বেতারে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার সর্বাধিক প্রকাশিত কাগজ আনন্দবাজার তার গানের প্রশংসাও করেছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলেন। ওই বছরই ঢাকায় রেডিও স্টেশনের শর্টওয়েভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এবং তালাত মাহমুদ একত্রে গাইলেন—‘খেওয়ান হার নেইয়া মোরি ক্যার দো পার’ গানখানি। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারে নিয়মিত গান করেছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে আবার কলকাতায় চলে গেলেন ফিরোজা বেগম। সে বছরই কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে তার সুরে বেশকিছু গান করেন। এভাবেই তার সঙ্গীত গুরু হয়ে উঠলেন কমল দাস গুপ্ত। তিনি নজরুলের কথার সুর দিতেন আর ফিরোজা তা কণ্ঠে তুলে নিতেন। এভাবে প্রতিদিন তাদের দু’জনার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হতো। মনের অজান্তে একজন আরেকজনকে মন দিলেন। ১৯৫৬ সালে কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হলো। ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করে কমল দাস গুপ্ত মুসলমান হয়ে হলেন—‘কামালউদ্দিন’। ১৯৫৭ সালে কলকাতা ছেড়ে দু’জনে চলে এলেন ঢাকায়। পাকিস্তানি আমল তখন। তাই ভারতে ফিরোজা বেগমের সমস্যা, আবার ঢাকায় কমল দাস গুপ্তের সমস্যা। ঢাকায় দু’জনে ফিরে এসে বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে দু’জনে যান, সেখানে মুখের ওপর দরজা বন্ধ। এজন্য বাড়িভাড়া পেতেও বেগ পেতে হলো। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কমল দাস গুপ্ত গৃহবন্দি ছিলেন ঢাকাতেই। সেসব কাহিনী তো এখন ইতিহাস। ১৯৭৪ সালে কমল দাস গুপ্ত মারা গেলে ফিরোজা বেগম একাকী হয়ে পড়লেন সন্তানদের নিয়ে। ফিরোজা বেগম যখন দেখলেন দেশে যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না, ঠিক সেই ক্ষণে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ছুটলেন একক অনুষ্ঠান করতে। যখন যেখানে গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাই তো বলতে হয়, শ্রোতার মনে, জনগণের হৃদয়ে তার ন্যায্য আসনটি যে পেয়েছেন—তাই তার জন্য যথেষ্ট নয় কি? কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাকেও তিনি গান শুনিয়েছেন—তখন তো তার কিশোরী বয়স। নজরুলের গান গাইতে গিয়ে তিনি এক সময় দেখলেন, নজরুলের লেখা প্রতিটি গান যেন বৈচিত্র্যে ভরা। এভাবেই তিনি নজরুলের গানের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। যতই নজরুলের গানের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকেন, বিস্ময়ের মাত্রা তার ততই বেড়ে যেতে থাকে। কথা, সুর, রাগের বৈচিত্র্য, তাল, ছন্দ—সব মিলিয়ে নজরুলের গান তাকে ভাবিয়ে তোলে। আর এভাবেই অনেক চেষ্টায় ফিরোজা বেগম নজরুলের অফুরান ভাণ্ডারের কিছু আয়ত্ত করে ফেললেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড করলেন, গানটি ছিল—‘গহনে গহনে সন্ধ্যা তারা’। এরপর থেকে তিনি নজরুলের গান নিয়েই পড়ে থাকলেন। এজন্য ফিরোজা বেগমকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেদিনের জনগণ সে কথা আজও ভোলেনি। নজরুলের গানের সেমিনার করা থেকে শুরু করে নানা রকম পরিকল্পনা করে এগিয়ে ছিলেন ফিরোজা বেগম। তিনি এগিয়েও ছিলেন। এভাবে তিনি নজরুলের গানকে জনপ্রিয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। আর তারই চেষ্টাতেই নজরুলসঙ্গীত আজ জনপ্রিয়। ঘরে ঘরে এ গান বাজে। এর পেছনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে ফিরোজা বেগমেরই। ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’, ‘খেলিছে জলদেবী’, ‘বলেছিলে তুমি আসিবে’, ‘বিরহের গুলবাগে’, ‘বনের তাপসী কুমারী’, ‘তুমি শুনিতে চেও না’, ‘কথা কও, কথা কও’, ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’, ‘মোমের পুতুল মমীর’, ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম খেজুর’, ‘বনফুলে তুমি মঞ্জরি’, ‘তোমার আসার আশায়’, ‘গলে টগরমালা’, ‘যুগ যুগ ধরি’, ‘প্রভু তোমারে খুঁজিয়া মরি’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ’, ‘প্রিয়তম এত প্রেম দিও না’, ‘আমি পূরব দেশের’, ‘কে বিদেশি বন উদাসী’, ‘বনমালার ফুল’সহ নজরুলের হাজারও গান তিনি গেয়েছেন, যা কিনা সিডিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারপরও একজন শিল্পীর তৃপ্তি কী মেটে! মেটে না। তাই তো ফিরোজা বেগম আরও গাইতে চান। তিনি শিল্পী, তাই তার মন পড়ে আছে গানের পানে। গান নিয়েই তিনি আছেন, থাকবেন আগামী দিনগুলোতেও—এই প্রত্যাশা তার লাখো ভক্তের। তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তিনি জনসমক্ষে এসে আবারও গেয়ে উঠবেন নজরুলের গান—‘আমি যুগ যুগ ধরে লোকে লোকে মোর প্রভুরে খুঁজিয়া বেড়াই’সহ হাজারও গান। আর এ জন্যই ফিরোজা বেগম নজরুলসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী।

রত্না থেকে শাবানা

ঢাকার ছবিতে ১৯৬২ সালে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে শাবানার আত্মপ্রকাশ ‘রত্না’ নামে। তখন তার বয়স ছিল এগারো কি বারো। ১৯৬৬ সালে উর্দু ছবি চকোরীতে রত্না থেকে তিনি হলেন ‘শাবানা’। ১৯৭০ পর্যন্ত উর্দু ও বাংলা এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কয়েকশ’ বাংলা ছবির নায়িকা ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে শাবানা অভিনয় করেছিলেন। ফয়েজ চৌধুরী তার মেয়ে রত্নাকে নিয়ে প্রায়ই এফডিসিতে আসতেন। এহতেশাম তখন ‘নতুন সুর’ নামে একটি ছবির কাজ নিয়েছেন। সেটা ছিল ১৯৬১ সালের কথা। একজন শিশু শিল্পী দরকার—রত্নাকে দেখে এহতেশাম পছন্দ করলেন। এভাবেই ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম অভিনয় জীবন শুরু হলো তার। তবে এরও অনেক পরে ১৯৬৬ সালে ‘চকোরী’ ছবি থেকে রত্না নাম পাল্টে তার নাম রাখা হলো শাবানা। ‘শাবানা’ নামটি দিলেন এহতেশাম নিজেই। শাবানার আসল নাম ছিল আফরোজা সুলতানা। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। জন্ম ১৯৫০ সালে। নায়িকা হওয়ার আগে শাবানা শিশু অভিনেত্রী হিসেবে তালাশ, সাগর, ভাইয়া ছবিতে অভিনয় করেন। নায়িকা হিসেবে তার অভিনয় শুরু ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে (১৯৬৬)। ওই ছবিতে সোনাভানের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তার নায়ক ছিলেন কাসেম। ‘চকোরী’ ছবিতে কাজ করার আগে ‘জংলী মেয়ে’ ছবির কাজ শুরু করেন তিনি। ‘জংলী মেয়ে’ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন আজিম। ‘চকোরী’ও মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। নায়ক ছিলেন নাদিম। এই ছবিতে শাবানা ও নাদিমের অসম্ভব নাম হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে নায়িকা হিসেবে চাঁদ আওর চাঁদনী, ভাগ্যচক্র ও কুলীতে; ১৯৬৯ সালে দাগ, মুক্তি; ১৯৭০ সালে পায়েল, সমাপ্তি, ছদ্মবেশী, বাবুল, মধুমিলন এবং একই অঙ্গে এত রূপ ছবিতে অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা এগারোজন’-এ অভিনয় করেন শাবানা। ওই বছরই ‘অবুঝ মন’ ছবিতে অভিনয় করে সারাদেশে অসম্ভব খ্যাতি পেলেন। ১৯৭২ সালে এ দুটি ছবিসহ তার আরও ৬টি ছবি রিলিজ হয়। এ ছবিগুলো হলো—সমাধান, ছন্দ হারিয়ে গেল, এরাও মানুষ, মুন্না আওর বিজলী, চৌধুরী বাড়ী আর স্বীকৃতি। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো—ফকির মজনু শাহ, চাষার মেয়ে, উত্সর্গ, মায়ার বাঁধন, আগুন, সোহাগ, মাটির ঘর, বধূ বিদায়, দুই পয়সার আলতা, লালুভুলু, ভাত দে, লাল কাজল প্রভৃতি। পাকিস্তান আমলে উর্দু ছবিতে নাদিমের সঙ্গে অভিনয় করে সফল হয়েছিলেন এই শাবানা। রাজ্জাক, ওয়াসিম, আলমগীর এরাও শাবানার নায়ক ছিলেন। শাবানা একবার জানিয়েছিলেন, রাজ্জাক ও আমি জুটি হিসেবে যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ঠিক তখনই আলমগীরের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হলাম। সামাজিক ছবিতে আমরা সফল হয়েছিলাম। আমার ক্যারিয়ার গঠনে অনেক পরিচালকের অবদান রয়েছে। এহতেশাম চাচা যদি সুযোগ না দিতেন তাহলে হয়তো ‘শাবানা’ হতে পারতাম না। সামাজিক চরিত্রে নতুন ইমেজে আমাকে পরিচিত করার ব্যাপারে কাজী জহির, মমতাজ আলী, কামাল আহমেদ-এর অবদান কোনো দিন মন থেকে সরে যাবে না। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শাবানা ঢাকার ফিল্মে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কয়েকশ’ ছবির নায়িকা ছিলেন। পোশাকী, সামাজিক, অ্যাকশন সব ছবিতেই তিনি সফল হয়েছিলেন। তার অভিনীত উল্লেম্লখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে—চকোরী (১৯৬৭), জংলী মেয়ে (১৯৬৭), চাঁদ আওর চাঁদনী (১৯৬৭), কুলি (১৯৬৮), পায়েল (১৯৬৯), ছদ্মবেশী (১৯৭০), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৭০), ওরা এগারোজন (১৯৭২), মুন্না আওর বিজলী (১৯৭২), অবুঝ মন (১৯৭২), দস্যুরানী (১৯৭৩), মালকা বানু (১৯৭৪), দুই রাজকুমার (১৯৭৫), অনেক প্রেম অনেক জ্বালা (১৯৭৫), জীবন সাথী (১৯৭৬), রাজ দুলারী (১৯৭৮), বধূ বিদায় (১৯৭৮), কাপুরুষ (১৯৭৮), ফকির মজনু শাহ (১৯৭৮), আয়না (১৯৭৯), চোখের মণি (১৯৭৯), বিজয়িনী সোনাভান (১৯৭৯), সাথী তুমি কার (১৯৮০), দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), লাল কাজল (১৯৮২), বানজারান (১৯৮৩), মরণের পরে (১৯৮৯), কাজের বেটি রহিমা (১৯৯১), স্বামীর আদেশ (১৯৯১), অন্ধ বিশ্বাস (১৯৯২) প্রভৃতি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় শাবানা চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। তা প্রায় ১৮ বছর হয়ে এল। তবুও শাবানা নামটি এখন পর্যন্ত দর্শকের মুখে মুখে থেকে গেল। আর এ জন্যই শাবানা ঢাকার ফিল্মে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।

ঢাকার ফিল্মের রাজপুত্তুর রাজ্জাক

১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করার পর রাজ্জাকের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নায়ক হিসেবে এ ছবিতে অভিনয় করলেও এর আগে তিনি অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে এ পর্যন্ত রাজ্জাক ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন তারকার পক্ষে এতগুলো ছবিতে অভিনয় করা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। ঢাকার ছবিতে রাজ্জাকই প্রথম তারকা প্রথা চালু করেছিলেন। তিনি যখন ছবিতে নায়ক ছিলেন তখন সর্বশ্রেণীর মানুষ ছবি দেখত। তার অভিনীত ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, জীবন থেকে নেয়া, অবুঝ মন, প্রতিনিধি দর্শকরা বার বার দেখেছে। পুরনোরা নয়, এ প্রজন্মের দর্শকরাও রাজ্জাককে বলেন ‘নায়করাজ’। তাই তো তিনি জীবদ্দশায় কিংবদন্তির তারকা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। রাজ্জাক একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার নাগতলায়। কিশোর বয়স থেকে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চনাটকে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে পড়ার সময় ‘রতন লাল বাঙালী’ নামে একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার কারণে স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে দেখা করেন। তারই সহায়তায় যোগ দেন ইকবাল ফিল্মস লিমিটেডে। এখানে মাসে সামান্য বেতন পেতেন। পাশাপাশি মঞ্চ ও টেলিভিশনে নাটক করে যা পেতেন তা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালাতেন। ১৯৬৫ সালে ইকবাল ফিল্মসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিচালক কামাল আহমদের সহকারী হলেন। সে সময় দুই-তিনটি ছবিতে তিনি অতিরিক্ত শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার পর থেকে রাজ্জাকের যথার্থ উত্থান ঘটে। ছবিটি মুক্তির পর দলে দলে দর্শক ছবিঘরে ভিড় করে। কোনো কোনো প্রেক্ষাগৃহে ‘বেহুলা’ একটানা ছয় মাস পর্যন্তও প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘বেহুলা’ মুক্তির পর চলচ্চিত্র প্রযোজকরা দীর্ঘদিন পর একজন সুদর্শন নায়কের দেখা পেলেন। যে জন্য ছবি নির্মাতারা ছবি নির্মাণের জন্য তখন থেকেই রাজ্জাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠল। ১৯৬৬ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সুজাতা, সুচন্দা ও কবরীর বিপরীতেই তিনি বেশি অভিনয় করেছেন। ওই সময়ের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংসার, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, টাকা আনা পাই, মধু মিলন, জীবন থেকে নেয়া, দর্পচূর্ণ প্রভৃতি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ রাজ্জাকের জীবনে এক স্মরণীয় ছবি। ছবিটি রিলিজের পর গুলিস্তান ছবিঘরে ছবিটি দেখেছিলেন তিনি। ছবির নির্মাতা জহির রায়হান সাহেব এর আগে ‘বেহুলা’ আর ‘আনোয়ারা’ ছবিতে অভিনেতাকে নিয়েছিলেন। তার পরিচালিত প্রতিটি ছবি ছিল জীবনবোধে উজ্জীবিত শিল্পধর্মী। জহির রায়হানই সার্বিক অর্থে গণমানুষের রাজনীতি ও বাঁচার সংগ্রামকে সেলুলয়েডে চিত্রায়ন করে গেছেন। সত্তর দশকের প্রথম দিক থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল তার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। প্রতিদিনই তাকে ২০ ঘণ্টা করে সময় দিতে হতো ছবির কাজে। তার অভিনীত অধিকাংশ ছবিই ছিল ব্যবসায়িক দিক দিয়ে দারুণ সফল। ঢাকার প্রথম স্বীকৃত অ্যাকশনধর্মী ছবি ‘রংবাজ’-এ এই রাজ্জাকই প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ঢাকায় প্রথম এসে কমলাপুরে নিম্নমানের এক বাসায় রাজ্জাককে বাসা ভাড়া করে কোনোভাবে দিন কাটাতে হয়েছিল। সেই রাজ্জাক নিজের অক্লান্ত চেষ্টা, ত্যাগ আর ধৈর্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু বছর ধরে তিনি কোটিপতি। পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে থাকেন গুলশানের লক্ষ্মীকুঞ্জে। কয়েকবার তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনিই। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সাবেক শুভেচ্ছা দূতও ছিলেন। তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি হলো—আকাঙ্ক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, আপনজন, মৌচোর, বদনাম, সত্ ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বৌ, জীনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির প্রভৃতি। রাজ্জাকের পথ ধরেই তার দুই ছেলে বাপ্পা রাজ ও সম্রাট ফিল্মের নায়ক হয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই রাজ্জাকের অতীত সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। ১৯৭২ থেকে ’৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—স্লোগান, আমার জন্মভূমি, অতিথি, কে তুমি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, প্রিয়তমা, পলাতক, ঝড়ের পাখি, খেলাঘর, চোখের জলে, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ভাইবোন, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, গুণ্ডা, আগুন, মতিমহল, অমর প্রেম, যাদুর বাঁশী, অগ্নিশিখা, বন্ধু, কাপুরুষ, অশিক্ষিত, সখি তুমি কার, নাগিন, আনারকলি, লাইলী মজনু, লালু ভুলু, স্বাক্ষর, দেবর ভাবী, রাম রহিম জন, আদরের বোন, দরবার, সতীনের সংসার প্রভৃতি। চলচ্চিত্রই তাকে দিয়েছে সহায়-সম্পত্তি, সুনাম-খ্যাতি। আর এজন্যই রাজ্জাক এখনও রয়েছেন ফিল্মের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছরই নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে একটি করে ছবিও উপহার দিচ্ছেন। রাজ্জাক একটা যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এই তো সেদিনও ফিল্মে ছিল তার আকাশছোঁয়া খ্যাতি। আর এ জন্যই ঢাকার ফিল্মে তিনিই প্রথম ও সর্বশেষ রাজপুত্তুর।

সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ সোহরাব হোসেন

নদীয়ার নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নামে আজও চলে বন্দনা। সেই নদীয়া জেলার আয়েশতলা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন একটি ফুটফুটে সুন্দর ছেলে। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন—‘সোহরাব’। তার বাড়ির পাশে ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ি। সারাদিন ঢাকঢোল-বাদ্য বাজতো আর কীর্তন গানে মুখরিত থাকত জমিদারবাড়ি। ছেলেটি প্রায় দিনই ছুটে আসত, কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে তার মনেও ইচ্ছে জাগল—কী করে গাইব। পরবর্তী সময়ে রেকর্ডে ও রেডিওতে গান গাইবার সুযোগ পেলেন ছেলেটি। এভাবে নাম হয়ে গেল সোহরাব হোসেনের। ঘরে ঘরে বাজতে লাগল তার কণ্ঠে গাওয়া—‘মোহাম্মদ মোর নয়নমণি মোহাম্মদ নাম জপমালা’। এ গান দিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন মস্ত বড় শিল্পী। কণ্ঠশিল্পী সোহরাব হোসেনের বয়স এখন প্রায় ৯০। এই বয়সেও সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত তিনি। এখন তো আর আগের মতো করে গাইতে পারেন না। তবে এ প্রজন্মের শিল্পীদের যথাসাধ্য সঙ্গীতের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তার খ্যাতি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদকও পেয়েছেন তিনি। দেশ তাকে যথাসাধ্য মর্যাদাও দিয়েছে। যে জন্য সোহরাব হোসেনের কোনো ক্ষোভ কিংবা দুঃখ থাকার কথা নয়। জীবনের পড়ন্ত বেলার দিনগুলো মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গীত বিচারক হিসেবে বিভিন্ন চ্যানেলে, নজরুল একাডেমিতে ডাক পড়লেও এ বয়সে সেভাবে আর যেতে পারছেন না। তবুও মাঝে মধ্যে ইচ্ছে পূরণ করছেন। সোহরাব হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল আয়েশতলা গ্রামে। ওই জায়গা এখন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় রয়ে গেছে। মাত্র ৫ বছর বয়সে নানা তমিজউদ্দিন মিয়ার কণ্ঠে—‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানখানি শুনেই সঙ্গীতের প্রতি দুর্বল হন। তারপর থেকে ঘরে বসে আপন মনে গান গাইতেন। বাড়ির কাছেই ছিল জমিদারদের বাগান। গান শেখার জন্য প্রতিদিন রাতে যেতেন সেখানে। তখনকার সমাজ এটা মেনে নিতে পারেনি। গান গাইতে দেখলেই তখন তিরস্কার করা হতো। মুসলমানের ছেলে হয়ে গান করার কারণে সোহরাব হোসেনকে অনেক গালমন্দের সঙ্গে বাধা-বিপত্তি সহ্য করতে হয়েছিল। নানা রকমের কথাও শুনতে হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে, গান-বাজনা হারাম। সোহরাব হোসেন ওইসব কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি ভাবতেন, আব্বাসউদ্দিন, কে মল্লিক—ওরা মুসলমান হয়ে যদি গান গাইতে পারেন তাহলে আমি কেন পারব না! গান তিনি ছাড়েননি। প্রথম গান শেখেন জয়নাল আবেদিনের কাছে। এরপর কিরণ দে চৌধুরীর কাছে। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বেতারে সঙ্গীত পাবলিসিটিতে সোহরাব হোসেনের চাকরি হয়। ওই সময় তিনি আব্বাসউদ্দিন আহমদ ও গিরিন চক্রবর্তীর কাছে কিছুদিন গান শিখলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রায়ই নাটক দেখতে যেতেন। উদ্দেশ্য ছিল—ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালাসহ তখনকার নামিদামি শিল্পীদের কণ্ঠে গান শোনা। তাদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে মুগ্ধ হতেন। ধীরে ধীরে গানে পারদর্শী হলেন। আর এভাবে একদিন কলকাতা বেতারে ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে গান করার সুযোগ পেলেন। সেটা ছিল ১৯৪৬ সালের কথা। উপমহাদেশ ভাগাভাগির পর আর কলকাতায় থাকা হলো না তার। ১৯৪৮ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে এইচএমভি থেকে সোহরাব হোসেনের একটি রেকর্ড বের হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বেশি হয়নি সোহরাব হোসেনের। তিনি এ প্রসঙ্গে জানিয়ে ছিলেন, নজরুল ইসলামের কণ্ঠে মাত্র দু’বার স্টেজে গান শুনেছি। ১০ কি ১১ বছর বয়সে তাকে রানাঘাট স্টেশনে প্রথম দেখি। কলকাতায় যখন যাওয়া-আসা শুরু করি তখন তার সঙ্গে দেখা হওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। সবুর খান, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন, গিরিন চক্রবর্তী—এরা একত্রে মেলামেশা করতেন। দূর থেকে দেখেছি, কিন্তু তাদের ধারে-কাছে যেতে কেমন জানি লজ্জা বা সঙ্কোচ লাগত। কেননা, উনারাতো কতই না নামিদামি ব্যক্তি! সোহরাব হোসেন এক সময় চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক করেছেন। মাটির পাহাড়, এ দেশ তোমার আমার, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল, যে নদী মরুপথে প্রভৃতি ছবিতে গেয়েছেন স্মরণীয় কিছু গান। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই সব গানের কথা এখন আর সোহরাব হোসেনের খুব একটা মনে পড়ে না। তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন লুত্ফর রহমান, ওসমান খান, মমতাজ আলী খান, আবদুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ। এরা আজ আর কেউই বেঁচে নেই। এই বয়সে সোহরাব হোসেনের খুব করে মনে পড়ে—নদীয়ার সেই দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে প্রিয় বন্ধুদের কথা। কিন্তু তিনি বলেন, অতীত ভেবে আর তো লাভ হবে না। যে দিন চলে গেছে সেদিন তো আর ফিরে আসবে না...। সোহরাব হোসেনের ৫ ছেলেমেয়ে। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে রওশন আরা সোমা থাকে কাতারে, মেজ মেয়ে রাহাত আরা গীতি ঢাকাতেই থাকে, সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত। ৯০ বছর বয়সেও তিনি কণ্ঠে তারুণ্য ধরে রেখেছেন, যা অনেকেই পারেন না। সঙ্গীতে নিবেদিত প্রবাদ-পুরুষ সোহরাব হোসেনও জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে রইলেন।

ট্রাজেডি কিং দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার...। ভারতীয় অভিনয় জগতে এক বিশাল মহীরুহ, এক জীবন্ত ইতিহাস। তার অবদান কোনো দিন ভোলা যাবে না। ‘আন’ ছবিতে নাদিরার সঙ্গে, ‘মোঘল-এ-আজম’ ছবিতে মধুবালার সঙ্গে, ‘দেবদাস’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে, ‘দাগ’ ছবিতে নিমির সঙ্গে, ‘মেলা’ ছবিতে নার্গিসের সঙ্গে, ‘আজাদ’ ছবিতে মীনা কুমারীর সঙ্গে, ‘জুগনু’ ছবিতে নূর জাহানের সঙ্গে এবং ‘গঙ্গা-যমুনা’ ছবিতে বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে দিলীপ কুমারের অভিনয়ের কথা দর্শকরা হয়তো চিরকাল মনে রাখবে। সেই দিলীপ কুমারের বয়স এখন নব্বই। যিনি একদা দিলীপ কুমারের ছবি দেখতেন, পরবর্তী সময়ে তার ছেলে আর এখন তার নাতিরাও দিলীপ কুমারের ছবি দেখেন বড় আগ্রহ নিয়ে। গিনেজ বুকেও তার নাম উঠেছে। অভিনয় করে কত যে পুরস্কার পেয়েছেন তার হিসাব নেই। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন ২০ বছর বয়স্ক সায়রা বানুকে। ১৯৬৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। এখনও তারা একই বাড়িতে রয়ে গেছেন। বৃদ্ধ দিলীপ কুমারের দিন কাটে এখন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বই-পুস্তক পড়ে। এ বয়সে খুব প্রয়োজন না হলে আর বের হন না। বহু বছর ধরে তিনি মুম্বাইর পালি হিলের বিশাল বাংলো বাড়িতে বসবাস করছেন। দিলীপ ও সায়র এখন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পড়ন্ত বেলায় দিলীপের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কতই না স্মৃতিময় ঘটনা, যা তিনি আর কোনো দিনই ফিরে পাবেন না। দিলীপ কুমারের আসল নাম ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে এক গোঁড়া মুসলিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা গোলাম সারওয়ার খানের ১২ সন্তানের মাঝে দিলীপ ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ফলের ব্যবসা করতেন। তাদের ফলের দোকান থেকে সুদূর নাগপুর, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, চেন্নাই, ভুপাল প্রভৃতি বড় বড় শহরে ফল চালান করা হতো। ছয় বছর বয়সে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে দিলীপ কুমার পেশোয়ার ছেড়ে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে এলেন। দিলীপ কুমার নামটি তার তখনও হয়নি ‘ইউসুফ’ কিংবা লাল বলে সবাই ডাকত। মুম্বাইর দিওলালির আঞ্জুমান-ই-ইসলাম স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে উইলসন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজে এসে পড়াশোনায় দিলীপের মন কিছুতেই বসতে চাইল না। বইয়ের চেয়ে বরং হাজার গুন পছন্দ হলো তার ফুটবল খেলা। যখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেন, তখন তিনি ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ঠিক করলেন আর পড়বেন না। কিছুদিন ফলের ব্যবসায় নেমে দিলীপ মোটেই আনন্দ পেলেন না। তাই ব্যবসা ছেড়ে চাকরির উদ্দেশে রওনা হয়ে যান পুনায়। সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে ম্যানেজারের পদে ৩৫ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন। এত অল্প মাইনেতেও তিনি ধৈর্য হারাননি। তিন মাস যাওয়ার পর ৩৫ টাকা থেকে তার মাসিক আয় দাঁড়াল আটশ’ টাকাতে। বেশ কিছু টাকা জমিয়ে এবার তিনি অফিসারদের মেসে একটা বার খুলে বসলেন। বেশ লাভবান হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু দিন পর বার উঠে গেল। এরপর ব্যবসা গুটিয়ে বম্বেতে ফিরে এসে কিছুদিন থাকার পর নৈনিতালে বেড়াতে গেলেন। সে সময় তার এক বন্ধু তাকে চিত্র নায়িকা দেবিকা রানীর কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেবিকা রানী তখন বম্বে টকিজের কন্ট্রোলার অব প্রোডাকশন পদে বহাল ছিলেন। দিলীপকে দেখেই তিনি বম্বে টকিজের আগামী ছবি জোয়ার ভাটায় অভিনয়ের জন্য মনোনীত করে বসলেন। ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে তাকে দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকায় নেয়া হয়েছিল। ইউসুফ খান নাম পাল্টে ছবিতে তার নাম রাখা হলো ‘দিলীপ কুমার’। সেদিন এ নামটি দিয়েছিলেন দেবিকা রানীই। বম্বে টকিজের আর্টিস্ট হয়ে তিনি মাসিক বেতন পেতেন ৬২৫ টাকা। ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। এ ছবিতে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মনে বিশেষ দাগ না কাটতে না পারলেও জনতা জানল দিলীপ কুমার নামে একজন নতুন নায়ক এসেছেন। দিলীপের দ্বিতীয় ছবি ‘প্রতিমা’। এ ছবিতেই তিনি সর্ব প্রথম একক নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। নায়িকা ছিলেন স্বর্ণলতা। তৃতীয় ছবি ‘মিলন’-এ তার সঙ্গে ছিলেন রঞ্জনা ও মীরা মিশ্র। ১৯৪৫ সালে শহীদ ছবিতে অভিনয়ের পর থেকে দিলীপের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শহীদ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। এর পর তারা জুটি হিসেবে নদীয়া কে পার, আরজু ও শবনম ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগেই নায়িকা-গায়িকা নূর জাহানের বিপরীতে দিলীপ অভিনয় করলেন জগনু ছবিতে। এরপর একে একে আরও অনেক নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করলেন ঘর কি ইজ্জত, বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, দিদার, হালচাল, দাগ, আন, সংদীল প্রভৃতি ছবিতে। ঘর কি ইজ্জত-এ তার নায়িকা ছিলেন মমতাজ শান্তি। নার্গিসের সঙ্গে বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, আন্দাজ, দিদার, জোগন প্রভৃতিতে অভিনয় করেন। এক সময় নার্গিসের সঙ্গে দিলীপের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজ কাপুরের জন্য তা বেশি দূর আগাতে পারেনি। ১৯৪৯ সালের কথা—সংদীল ছবিতে নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাষ্ট হলেন দিলীপ ও মধুবালা। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই এরা একে অন্যকে ভালোবাসলেন। মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান ওদের প্রেমের কথা জেনে ক্ষেপে গেলেন। মধুবালাকে বেশ মারধরও করলেন। পরবর্তী সময়ে দিলীপ ও মধুবালার মধ্যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য হয় এবং ওদের প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫৪ সালে। দিলীপ ও মধুবালা জুটির তারানা, সংদীল, মোঘল-এ আজম ছবি তিনটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। মোঘল-এ আজম, ভারতবর্ষের ফিল্ম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৬০ সালে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ছবিঘরে দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছিল। বাংলা ছবি সাগিনা মাহাতোতে অভিনয় করার জন্য ১৯৬৭ সালে দিলীপ কুমার কলকাতায় এসেছিলেন। এ ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সায়রা বানু। তখন তো সায়রা বানু তার স্ত্রী। ১৯৮৬ সালে দিলীপ কুমার আসমা বেগম নামে এক মহিলার প্রেমে জড়িয়ে পড়ার কারণে সায়রার সঙ্গে সম্পর্কে কিছুদিন ফাটল দেখা দেয়। পরে সায়রার মা নাসিমা বানুর হস্তক্ষেপে দিলীয় ও আসমার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে সেসব রচনার অবসান ঘটিয়েছিলেন। ইন মানিয়াত্, আন্দাজ, জোগন, দাগ, দিদার ছবিতে দিলীপ ছিলেন বিয়োগান্তক চরিত্রে। এসব ছবিতে তার অভিনয় প্রাণবন্ত হয়েছিল আর এ জন্যই দর্শকরা তাকে বলতো ট্র্যাজেডি কিং কিংবদন্তির এই তারকার ছবিগুলো ভিডিও সিডির বদৌলতে দর্শকরা এখনও ঘরে বসে দেখে থাকেন। ১৯৪৩ থেকে এ পর্যন্ত দিলীপ কুমার অভিনীত ছবির সংখ্যা ৭৮টি। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রথম ছবি ক্রান্তি ১৯৭৯। তার অভিনীত প্রতিটি ছবিই উল্লেখযোগ্য অর্থাত্ স্মরণীয়। কেননা তিনি একত্রে ১০টি কী ১২টি ছবি হাতে নিতেন না। বছরে ১টি বা ২টি ছবি হাতে নিতেন। যে জন্য তিনি চরিত্রের গভীরে যেতে পারতেন। এ কারণে শুধু সেদিনের দর্শকদের স্মৃতিতে নয়, একালের দর্শকদেরও ভালো লাগে তার অভিনীত মেলা, আন্দাজ, নদীয়াকে পাড়, বাবুল, দিদার, তারানা, নয়া দৌড়, দিলদিয়া দর্দলিয়া, সংঘর্ষ, দেবদাস, মিলন, জুগনু, মোঘল-এ আজম, পানসহ প্রতিটি ছবি।

এপ্রিল ১৮, ২০১১

অ ম র শি ল্পী আবদুল আলীম

১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিতে মাঝির গান—‘আমি ভিন গেরামের নাইয়া’ রুপালি পর্দায় এই গানের দৃশ্য দেখে হাজারও দর্শক-শ্রোতা গানের শিল্পী আবদুল আলীমের প্রশংসা করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রুপালি পর্দার আর রেকর্ডের গানে তার অসম্ভব খ্যাতি ছিল। মঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনেও তিনি ছিলেন ব্যস্ত। পল্লীসঙ্গীত গেয়ে তিনি বাঙালির হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিলেন। তার গাওয়া ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘রুপালি নদীরে’, ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল’, ‘ভাটির গাঙে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাওরে বন্ধু’, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’, ‘তেরে ইস নাদিয়ানে মুঝকো কেয়া কেয়া রঙ্গ দেখায়ে কিতনে রঙ রঙিলে মাঝি গুজরে পাল উড়ায়ে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’—এরকম কত শত গান এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। পল্লীগীতির এই অমর শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে। পিতার নাম ইউসুফ আলী। শৈশবেই আলীম তার পিতাকে হারান। এ অবস্থায় তার মনের কোণে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই বিচ্ছেদই তাকে সঙ্গীতের দিকে টেনে নিয়েছিল। প্রায়ই গুন গুন করে তিনি গাইতেন, বৃদ্ধ পিতামহ (দাদা) অলক্ষ্যে তা দাঁড়িয়ে শুনে যেতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতেন তার চেয়েও বেশি। স্কুলে যখন ভালো লাগতো না তখন আলীম চলে আসতেন ভাগিরথী নদীর পাড়ে। ওখানে বসে নদীর দৃশ্য দেখে আর মাঝির কণ্ঠে গান শুনে ভাবতেন, কী করে রেকর্ডে গান করা যায়। কবেইবা কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীতে গান করবেন তিনি— এসব ভাবনা তাকে প্রায় সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। পাশের গ্রামে এক বাড়িতে ছিল কলের গান। প্রতিদিন ওই বাড়িতে গিয়ে কলের গানে কে. মল্লিক, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, রঞ্জিত রায়, অনিমা সেনগুপ্তা, পাহাড়ী সান্যাল, যুুথিকা রায়, তসের আলীসহ কত না শিল্পীর গান শুনে শুনে আবদুল আলীম নিজেও ওইভাবে গাইতে চেষ্টা করতেন। মা চাইতেন, ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু আলীম লেখাপড়া বাদ দিয়ে গান-বাজনায় মশগুল হয়ে পড়ল। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আবদুল আলীম নদীর পাড়ে বসে গান গাইতে গাইতে এক সময় মঞ্চে তার ডাক পড়ে। ১৯৪২ সালের কথা। মাত্র ১২ বছর বয়সে গুরু সৈয়দ গোলাম আলীর হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি । তার গ্রামের এক আত্মীয় তখনকার কলকাতার মেয়র। তাকে গান শোনালেন, গান শুনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাকে কলকাতায় রেখে দিলেন। এরপর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাকে নিয়ে যেতে লাগলেন গান গাওয়ানোর জন্য। এক সময় কলকাতার সব আসরে আলীমের উপস্থিতি আবশ্যিক হয়ে উঠল। এভাবে একদিন পরিচয় হয়ে গেল অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হকের সঙ্গে। তার স্নেহ লাভ করল আবদুল আলীম। তখন তো কলকাতার মঞ্চে গান গাইতেন তসের আলী, ওসমান খান, নুরুন্নাহার, নুরুদ্দিন, নায়েব আলী, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন প্রমুখ। তাদের পাশাপাশি যোগ হলেন এই আবদুল আলীম। মোহাম্মদ সুলতানের সহযোগিতায় কাজী নজরুল ইসলামের সুরে প্রথম রেকর্ডে তিনি গাইলেন ‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো সঙ্গে নিয়ে যাই’ এবং ‘আফতাব ওই বসলো পাটে আঁধার আইল শেষে’ গান দু’খানি। এর আগে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ‘উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়’ গানটি গেয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে শুনিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হলে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন ঢাকায়। এরপর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত পল্লীগীতি পরিবেশন করতে থাকেন। ১৯৫২ সালের বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনের লাহোর অধিবেশনে আলীমের যোগদান করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে পল্লীগীতি গেয়ে তিনি অকৃপণ প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ৫০টি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবদুল আলীম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখ ও মুখোশ, এদেশ তোমার আমার, জোয়ার এলো, সুতরাং, নদী ও নারী, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাত ভাই চম্পা, স্বর্ণকমল, গাঁয়ের বধূ, লালন ফকির, দস্যুরানী, উত্সর্গ, তীর ভাঙা ঢেউ। এসব ছবিতে শিল্পীর গাওয়া গান এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। আবদুল আলীম ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গীত প্রেমিকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তিনি চলে গেলেও তার গান এ প্রজন্মের শিল্পীরাও বিভিন্ন চ্যানেলে গেয়ে বাহবা পাচ্ছেন। অসংখ্য ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ইসলামী আর লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে আবদুল আলীম অমর হয়ে থাকবেন।

রাজকাপুরের নায়িকা নার্গিস

রাজকাপুরের ছবিতেই নার্গিস অভিনয় করে এখন পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে আছেন। বরসাত, শ্রী ৪২০, আওয়ারা, আন্দাজ, জাগতে রহো, আহ ছবিগুলোয় নার্গিসের নায়ক ছিলেন রাজ কাপুর। রাজ কাপুর-নার্গিস জুটির অনবদ্য অভিনয় দীপ্তির প্রসার ঘটেছিল আর কে ব্যানার থেকেই। নার্গিস নামে নানা কল্পিত কথা আর কে ফিল্মস থেকেই শুরু হয় এবং ওখানেই শেষ। তারপর কিংবদন্তি হয়ে রইলেন চিরকালের নায়িকা নার্গিস। নার্গিসের জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জুন কলকাতায়। তাঁর মা জড্ডন বাঈ একসময় প্রখ্যাত গায়িকা ছিলেন। আর নার্গিসের বাবার নাম ডা. উত্তম চাঁদ মোহন। জড্ডন বাঈকে বিয়ে করে ডা. উত্তম চাঁদ মোহন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। জড্ডন বাঈয়ের প্রথম দুই পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তারা হলেন আখতার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন। সবশেষে নার্গিসের জন্ম। জড্ডন বাঈ কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেন। এর মধ্যে ‘তালামি হক’ ছবিটি উল্লেখযোগ্য। এই ছবিতে নার্গিস বেবী রানী নামে শিশু শিল্পীর ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন। তখন নার্গিসের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। জড্ডন বাঈয়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক। এ জন্য নার্গিসকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়তি মানুষকে কোন পথে চালিত করে কেউ তা বলতে পারে না। ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করার ইচ্ছে তার পূরণ হলো না। শেষতক তিনি ছবির নায়িকা হয়ে গেলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মেহবুব খান পরিচালিত ‘তকদির’ ছবিতে নায়িকা হওয়ার পর নার্গিসের নাম প্রথম ছড়িয়ে পড়ল উপমহাদেশজুড়ে। ১৯৪৩ সালে ‘তকদির’ মুক্তি পায়। নার্গিসের নায়ক ছিলেন মতিলাল। এরপর ১৯৪৮ সালে মেহেবুব খানের ‘আগ’ ছবিতে রাজ কাপুরের বিপরীতে নার্গিস অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে নার্গিস তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম চরিত্রাভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন—১৯৪৮ সালে ‘মেলা’, ‘১৯৪৯ সালে আন্দাজ, বরসাত; ১৯৫০ সালে বাবুল, যোগান; ১৯৫১ সালে আওয়ারা, দিদার, হালচাল; ১৯৫২ সালে আনহোনি, ১৯৫৬ সালে ‘জাগতে রহে’, ১৯৫৭ সালে মাদার ইন্ডিয়া, পরদেশী প্রভৃতি ছবিতে। নার্গিস তার নিজের প্রতিষ্ঠান নার্গিস আর্ট প্রোডাকশন থেকে ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘আনজুমান’, ‘দারোগাজী’ এবং ‘ভীস্ম প্রতীজ্ঞা’ ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে নার্গিস মায়ের ও সুনীল দত্ত তার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের শেষ দিকে নার্গিস ভারতের রাজ্যসভার একজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে যান চিকিত্সার জন্য। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি মুম্বাই প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পর ১৯৮১ সালের ৩ মে মারা যান। নার্গিসের জীবনে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—আনবান (১৯৪৪), ইসমত্ (১৯৪৪), বিসম্বাদী (১৯৪৫), হুমায়ুন (১৯৪৫), রামায়নি (১৯৪৫), নার্গিস (১৯৪৬), আনজুমান (১৯৪৮), বিরহ কি রাত (১৯৫০), জান যাহবান (১৯৫০), খেল (১৯৫০), মীনা বাজার (১৯৫০), পিয়ার (১৯৫০), সাগর (১৯৫১), আম্বার (১৯৫২), রেওয়াফা (১৯৫২), সিসা (১৯৫২), আহ (১৯৫৩), ধুন (১৯৫৩), শাদী (১৯৫৩), পাপী (১৯৫৩), আঙ্গারে (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), চোরি চোরি (১৯৫৬), মিস ইন্ডিয়া (১৯৫৬), লাজওয়ান্তি (১৯৫৮) ও পিয়ার কি ওয়াতন (১৯৬৭)। ‘নার্গিস-রাজ কাপুর’ জুটিকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, এর নিরানব্বই ভাগই ছিল রটনা। নার্গিস-রাজ কাপুর জুটি থেকেই সিনেমা জগতে জুটি বাঁধার সূত্রপাত, যার ফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে দিলীপ-মধুবালা, দেব-সুরাইয়া, ধর্মেন্দ্র-হেমা, অমিতাভ-রেখা প্রভৃতি জুটি গড়ে উঠেছিল। রাজ কাপুর ছাড়া নার্গিসের নায়ক ছিলেন—দিলীপ কুমার, মতিলাল, অশোক কুমার, জয়রাজ, বলরাজ মাহানী, করন দেওয়ান প্রমুখ। বিয়ের পর নার্গিস অভিনয় ছেড়ে দিলেও স্বামী সুনীল দত্তের চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায় তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন নেপথ্যে থেকে। সুনীল দত্ত প্রযোজিত পরিচালিত মুঝে জিনে দো, ইয়াদিন, রেশমা আউর শেরা, মন কা মিত ইত্যাদি ছবিতে নার্গিসের অবদান উল্লেখ করার মতো। অভিনয় জীবন ছেড়ে দিলেও নার্গিস চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনি সমাজসেবায় নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন। মুম্বাইর বস্তিতে ঘুরে তিনি দরিদ্র অসহায় লোকজনের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তার প্রতিকারের চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে তিনিও অবদান রেখে গেছেন। নার্গিসের স্বামী সুনীল দত্ত আজ আর বেঁচে নেই। তার বড় ছেলে সঞ্জয় দত্ত ফিল্মে এক সময় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সঞ্জয়দত্তের বয়স এখন ৪৯ বছর। মেয়ে নম্রতার বয়স ৪৬ বছর ও প্রিয়ার বয়স ৪২ বছর। আজও কোথাও রাজ কাপুরের কথা উঠলে ‘নার্গিস’ নামটি সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে। তবে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন না বটে; কিন্তু তারা বিদেশে গিয়ে একত্রে কাটিয়েছেন—এমন খবরাখবর সেদিনের পত্রপত্রিকাগুলো এখনও প্রমাণ বহন করে যাচ্ছে।

স্মরণীয় পরিচালক জহির রায়হান

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- এই গানখানি প্রথম চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। সেদিনের চলচ্চিত্র দর্শকরা আজও ভোলেননি জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কথা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি বানিয়ে অমর হয়ে রইলেন জহির রায়হান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি নির্মাণের আগে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা ‘অমর ৮ই ফাল্গুন’ নামে ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেলেন না। যে জন্য প্রথম দিকে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ছবি করার সুযোগ পাননি তিনি। তবে এ জন্য জহির রায়হান পিছপা হননি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের চিত্র তুলে ধরার জন্য ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে ছবি না বানালেও বানিয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবিতে ঠিকই একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তুলে ধরলেন। ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ রিলিজের পরে বাঙালি দর্শকরা বুঝতে পারল, পশ্চিমাদের সঙ্গে আর নয়। দলে দলে লোকজন এ ছবি দেখার পরে সবার মুখেই ফিরতে লাগল—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। এ ছবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল’ গানখানিও ছিল। ছবিঘরে বসে এই গান শুনতেই সেদিন জনতার দেহের পশম দাঁড়িয়ে গেল। এদিকে রক্ত টগবগ করে উঠল। বাঙালিরা স্লোগান তুলল—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলা মাকে মুক্ত করো।’ জহির রায়হান শুরু থেকেই পরিচ্ছন্ন ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন। জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি ১৯৭০ সালে গুলিস্তানসহ ঢাকার ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। মুক্তির আগে ছবিটি সেন্সরে আটকে দেয়। পরে এটি তত্কালীন সরকার রিলিজ দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির তিন দিন পরে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্র আন্দোলন হওয়ার কারণে তত্কালীন সরকার ছবিটি প্রদর্শনের জন্য আবার অনুমতি দেয়। জহির রায়হান একাধারে সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক রাজনৈতিক কর্মী, প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। জন্ম তাঁর ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে। তাঁর আসল নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম ছিল ‘জাফর’। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের পরিবার ছিল তাদের। বড় ভাই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)। জহির রায়হান ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। এক বছর পর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক, ‘প্রবাহ’-এর সম্পাদক এবং ‘এক্সপ্রেস’-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানী, সিনেমা, যুগের দাবি প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জহির রায়হান চলচ্চিত্রে প্রথম যোগ দিয়ে ছিলেন এজে কারদারের সহকারী হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৭) ছবিতে। ১৯৬০ সালে প্রথম পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ ছবিটির মাধ্যমে। জহির রায়হান পরিচালিত কাঁচের দেয়াল ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।‘কাঁচের দেয়াল’ পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির সম্মান অর্জন করেছিল। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংগম (১৯৬৫, এটি ছিল রঙিন ছবি), বাানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭) প্রভৃতি। তাঁর প্রযোজিত ছবি হলো-জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), মনের মতো বউ (১৯৬৯), শেষ পর্যন্ত (১৯৬৯) এবং প্রতিশোধ (১৯৭০)। প্রামাণ্য চিত্র হলো—স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), বার্থ অব এ নেশন (১৯৭১), লিবারেশন ফাইটার্স (১৯৭১) এবং ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স (১৯৭১)। তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো—শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), বরফ গলা নদী (১৯৬৯), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি কলকাতায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’ গঠন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে তিনি নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের স্ত্রী সুমিতা দেবী। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিটি নির্মাণের সময় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করন।

বাঙালির প্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেন

সেই কবে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’র বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে সুচিত্রা সেন ঝড় তুলেছিলেন বাঙালি হৃদয়ে। তারপর ৫৭ বছর কেটে গেছে। এদিকে তার বয়স এত দিনে আশির কোঠায় চলে এসেছে। তবুও সৌন্দর্য এবং সুচিত্রা সমার্থক হয়ে আছে বাঙালি দর্শকের চোখে। ‘অগ্নি পরীক্ষা’ ছবিতে অভিনয় করলেন ১৯৫৪ সালে। এ ছবিটি তাকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তো ‘পথে হলো দেরি’, ‘হারানো সুর’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’ ছবিগুলোর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই সুচিত্রা সেন। ১৯৭৮ সালে অভিনয় ছেড়ে দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত কোটি দর্শকের হার্টথ্রব। এপার বাংলা ওপার বাংলার জনগণমননন্দিতা চিত্র নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেনি। এখনও সুচিত্রা অনেকের হৃদয়ের রানী। কলকাতার বালিগঞ্জের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে তিনি বৃদ্ধা বয়সের দিনগুলো কাটাচ্ছেন এখন। তার দেখাশোনার জন্য রয়েছে কয়েকজন পরিচারিকা। চলাফেরা করতেও তার অসুবিধা হচ্ছে। তার ঘরে একমাত্র কন্যা মুন মুন সেন, নাতনিরাসহ নিকটাত্মীয়রা প্রবেশ করারই অনুমতি পাচ্ছেন। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতেও তিনি কখনও আগ্রহী ছিলেন না। গ্রেটা গার্বোর মতো তিনিও বরাবর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন। তার এ বয়সের দিনগুলো কাটছে পূজা-অর্চনা করে। কয়েক বছর আগেও তিনি ঘরে বসে টেলিভিশনে প্রদর্শিত তারই ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। এখন নাকি তার তাও ভালো লাগছে না। সুচিত্রা সেন তার জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে গেলেন। এই মহান নায়িকা সম্পর্কে জানা যায়, তার নায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা গেলে সেই রাতে এসেছিলেন একখানি মালা হাতে নিয়ে। মহা নায়িকা সুচিত্রা সেন মহানায়কের গলায় সেই মালা রেখে গিয়েছিলেন সেই রাতে। সুচিত্রা সেন ফিরে এলেন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, তারপর তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল বিহারের পাটনায়। জন্মের কয়েক বছর পর চলে এলেন পাবনাতে। শৈশবকাল কেটেছে পাবনা শহরে। সে সময় তার নাম ছিল রমা সেন। কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম বসন্তে তিনি অনেক নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাবনা ছেড়ে বাবার সঙ্গে চলে গেলেন কলকাতায়। ওই বছরই তার বিয়ে হয় আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথের সঙ্গে। শ্বশুরের যে সম্পত্তি ছিল তাতে স্বামী এবং তার ভালোভাবে দিন কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু দিবানাথ সেন এতই মদ খেতেন যে টাকা সংগ্রহের জন্য জায়গাজমি বিক্রি করে দেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে রমা সেনকে সিনেমায় নামতে হয়। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেন চলচ্চিত্র জগতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছবিটি মুক্তি পেল না। এরপর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে প্রতিষ্ঠা পেলেন। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন সমর রায়। সুচিত্রা সেন তার অভিনীত জীবনে মোট ৬০টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত একবার বলেছিলেন, “১৯৫১ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অসিত চৌধুরী আমাকে বললেন, একটি ভালো শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয় সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে খুব নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন ওর স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। দেখলাম, ছিপছিপে চেহারায় ডাগর ধরনের চোখ। চোখ দু’টি বড় সুন্দর আর খুব এক্সপ্রেসিভ, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উজ্জ্বলতায় ভরে যায়। এক নজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে একটু বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম।” ‘সাত নম্বর কয়েদি’র পরে পিনাকী মুখার্জির ‘সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও তিনি সুচিত্রা সেন নামে আসেননি। এর পরের ছবি অর্থাত্ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে তিনি রমা সেন পাল্টিয়ে সুচিত্রা সেন নামে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি ১৯৫২ সালে মুক্তি পায়। তখন বাংলা সিনেমায় দুঃসময় চলছিল। কানন দেবী, উমাশশী, সাধনা বসুর যুগ শেষ। ঠিক সেই সময় অনেকের চোখে তিনি ধরা পড়েন। তাছাড়া ওই সময় সুরাইয়া, নার্গিস, নিন্মি ও নাদিরার হিন্দি ছবি দেখার জন্য বাঙালি দর্শকের ভিড় উপচে পড়ত। সুচিত্রা সেনের আগমনে ভিড়টা ক্রমে চলে এলো বাংলা ছবির দিকে। সুচিত্রা সেন থাকলেই হলো। শুরু হলো সুচিত্রা সেনের অপ্রতিহত জয়যাত্রা। আরম্ভ হলো ভক্তদের কত উদ্ভট সব জল্পনা-কল্পনা। সুচিত্রা সেন কেমনভাবে দিন কাটান, কী খান, কীভাবে কথা বলেন ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা ও গবেষণা চলতে থাকে চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তায় কিংবা বাড়িতে, স্কুল-কলেজে। এমনিভাবে সুচিত্রাকে নিয়ে উদ্দাম কল্পনা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আনন্দের ব্যাপার এই যে এখন পর্যন্ত সেই কল্পনার সমাপ্তি ঘটেনি। ১৯৫৪ সালে তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে গেল। এ ছিল যেন বিস্ময়কর প্রতিভার এক স্বাক্ষর। ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘অন্ন পূর্ণার মন্দির’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অগ্রদূত’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘মরণের পরে’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’ প্রভৃতি ছিল ১৯৫৪ সালের ছবি। প্রতিটি ছবিই সে সময় ব্যবসাসফল হয়েছিল। উল্লিখিত ছবিগুলোয় সুচিত্রা সেনের নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। পরবর্তী সময়ে এই জুটি ঝড় তুললো সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), ত্রি ঘামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৬), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), সূর্যতোরণ (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাসা (১৯৬২), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির উত্তম কুমার মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। সুচিত্রা সেনও ফিল্ম লাইন ছেড়ে দিয়েছেন ৩৫ বছর আগে। তবুও এই জুটির পুরনো ছবিগুলো এখনও সমান জনপ্রিয়। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা সেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’, ‘প্রণয় পাশা’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘হসপিটাল’ সুচিত্রার জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন অশোক কুমার। এ ছাড়া অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে স্মৃতি টুকু থাক, বসন্ত চৌধুরীর বিপরীতে ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ ছবির কথাও যে ভোলার নয়। সুচিত্রা সেন হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। যেমন—মুসাফির, দেবদাস, বোম্বাইকা বাবু থেকে মমতা পর্যন্ত প্রায় ছয়-সাতখানা ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। হিন্দি ‘দেবদাস’-এ তিনি পার্বতীর ভূমিকায় ছিলেন আর দেবদাস সেজেছিলেন দিলীপ কুমার। ১৯৭০ সালের ২৯ নভেম্বর স্বামী দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পর সুচিত্রা সেন অসহায় হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ছবিতে আর অভিনয় নয়। নিকটতম ঘনিষ্ঠ কয়েকজন চিত্র পরিচালকের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি বলেই পরে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে ১৯৭৮ সালে ছবির জগত থেকে চিরতরে বিদায় নেন। শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন অনেক আগেই অতীতের গৌরবময় দিনগুলো হারিয়ে ১৯৮০ সালের পর থেকে একাকী জীবন কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন। আর এ জন্যই তিনি এরপর থেকে কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাত্কার দেননি। কাউকে ছবিও তোলার অনুমতি দেননি। এর কারণ এও হতে পারে যে নানা রংয়ের রঙিন দিনগুলো যে আর ফিরে পাবেন না। এটা কী কম কষ্টের ব্যাপার—এই অনুশোচনায় তিনি নীরব হয়ে গেলেন। আসলে গ্ল্যামার জগতেরই এ নিয়ম। পাবনা শহরে তার বাড়িটি যে ভাবে নীরব-নিস্তব্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক রূপকথার নায়িকা সুচিত্রা সেন ক্লান্ত হয়ে অবশেষে অনুরূপভাবে দাঁড়িয়ে আছেন-থমকে আছেন। তাকে নিকটাত্মীয়রা ছাড়া কেউই যে দেখতে পান না। আর এ জন্যই কোটি দর্শকের ইচ্ছে, সুচিত্রা সেনকে আরেকবার যে দেখতে চাই। কিন্তু সে ইচ্ছে যে আর পূরণ হওয়ার নয়। ইচ্ছেটা স্বপ্ন হয়েই থাকবে। কারণ সুচিত্রা সেন যে রহস্যময়ী। আর এ জন্যই তো তিনি কিংবদন্তি।

হলিউডের তারকা সোফিয়া লরেন

সোফিয়া অভিনেত্রী হয়েছিলেন, পাশাপাশি তাকে হতে হয়েছিল সেক্স সিম্বলও। তাই বোধহয় সার্থক অভিনেত্রীর পাশাপাশি প্লে গার্লের ইমেজও তাকে বয়ে বেড়াতে হয় এখনও। সোফিয়া লরেনের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমের এক অখ্যাত পরিবারে। তার কৈশোর জীবন কেটেছিল নেপলস শহরের উপকণ্ঠে নানার বাড়িতে। ছোটবেলায় তার চেহারা খুব সুন্দর ছিল না। একেবারে বিশ্রী অর্থাত্ কুিসত। তার ওপর হাত-পাগুলো ছিল ভীষণ লম্বা। অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থেকে তার অবস্থা এমনি হয়েছিল। ১২ বছর বয়স পূর্ণ হতেই তার সারা শরীরে আসে সৌন্দর্যের জোয়ার। এর পেছনে কাজ করেছিল প্রতিদিন শরীরের প্রতি যত্ন নেয়া। শরীর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অল্প বয়স থেকেই তিনি নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করেছিলেন। সোফিয়া লরেন ইতালিতে এবং হলিউডে দু’জায়গাতেই ছবি করেছেন। ১৯৫১ সাল থেকে সিনেমায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। এ পর্যন্ত তার ছবির সংখ্যা ষাটের বেশি হবে না। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—ও ম্যান অব দ্য রিভার, ‘দ্য কি’, ‘দ্যাট কাইন্ড অব ওম্যান’, ‘হেলার ইন পিংক টাইটস’, ‘টু উইমেন’, ‘বোক্কাচ্চিয়ো ৭০’, ‘ইয়েস্টারডে’, ‘টুডে’, ‘টুমরো’, ‘ম্যারেজ ইটালিয়ান স্টাইল’, ‘সান ফ্লাওয়ার’, ‘আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’, ‘আঞ্জেলা’, ‘রানিং অ্যাওয়ে’ প্রভৃতি। সোফিয়া লরেন ১৯৯১ সালে সম্মানসূচক অস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সবে তার সামগ্রিক চলচ্চিত্র কর্মের জন্য তাকে সম্মানিত করা হয়। অভিনেতা ক্যারি গ্রান্টের সঙ্গে এক সময় প্রেম করেছেন। তবে বিয়ে করেছেন প্রযোজক কার্লো পন্টিকে। সেই সোফিয়া লরেন ছবি করা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। ১৯৪৬ সালে রোমে চিত্রায়িত ‘কুদ ভাদিস’ নামে একটি ছবিতে সোফিয়া প্রথম অভিনয় করেছিলেন। অনেক কষ্টে এ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘কুদ ভাদিস’-এ সোফিয়া এবং তার মা দু’জনে অভিনয় করে ছিয়াত্তর ডলার পেয়েছিলেন। সোফিয়ার জন্মের আগে তার মা রোমিলডা একজন পুরুষকে ভালোবাসতেন। সেই প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের ফলেই রোমিলডা গর্ভবতী হন। লোকটি তাকে বিয়ে করতে আপত্তি জানায়। তার সন্তান যে ওই নারীর পেটে তা তিনি স্বীকার করলেন না। রোমিলডার গর্ভে জন্ম নিল এক সন্তান। ওই সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। দশের চোখে ছিল অবৈধ। সেই শিশুকন্যাই একদিন বড় হয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী হলেন। আর তিনিই তো সোফিয়া লরেন। সোফিয়ার মায়ের জীবন নিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়। ছবির গল্পের প্রধান চরিত্র ছিল সোফিয়ার মা রোমিলডা। ‘রোমিলডা’ নামের এই ছবিতে সোফিয়া মা ও মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। এই ছবি করা নিয়ে মায়ের সঙ্গে সোফিয়ার একটু মন কষাকষি ঘটেছিল। সোফিয়া লরেন প্রথমদিকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেন। উনিশ বছর বয়সে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘টম্পি নক্সি’ ছবিতে। তারপর রোমে আরও কয়েকটি ছবি করার পর ১৯৫৬ সালে তার ডাক এলো আমেরিকার হলিউড থেকে। হলিউডের ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি প্রযোজক কার্লো পন্টির কাছ থেকে বেশ সহযোগিতা পেলেন। কার্লো পন্টি তার নিজের ছবি ‘আফ্রিকা আন্ডারশিট’-এ সর্বপ্রথম নায়িকা হিসেবে সোফিয়াকে নিলেন। এরপর একে একে আট কি দশটি ছবিতে অভিনয় করলেন। ‘ও ম্যান অব দ্য রিভার’ ছবি নির্মাণকালে এ ছবির প্রযোজক-পরিচালক কার্লো পন্টির প্রেমে পড়লেন সোফিয়া লরেন। ১৯৫৭ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কার্লো পন্টি এর আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। সে ঘরে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল। ‘ও ম্যান অব দ্য রিভার’ ছবির মাধ্যমেই সোফিয়া লরেন ১৯৫৫ সালে ইতালির সেরা অভিনেত্রীর সম্মান লাভ করেছিলেন। ‘আফ্রিকা আন্ডার দ্য সি’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছিলেন। রাণী এলিজাবেথ এ ছবিটি দেখে এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ইতালির রোম ছেড়ে আমেরিকার হলিউডে যাওয়ার পর একেকটি ছবিতে অভিনয় করে তিনি ৮ লাখ ডলার করে পেতেন। পরে পারিশ্রমিক আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভালো অভিনয় করা সত্ত্বেও চিত্র সমালোচকরা সোফিয়াকে দেহসর্বস্ব অভিনেত্রী বলেই গণ্য করতেন। তাদের মতে, সোফিয়ার স্বাস্থ্য সমুজ্জ্বল দেহই হলো তার জনপ্রিয়তার কারণ। কিন্তু ‘ডিপায়ার আন্ডার দ্য এলমস’ এবং ‘টু ও ম্যান’ ছবি দুটি মুক্তি পাওয়ার পর চিত্র সমালোচকদের মত পালটে গেল। ‘ক্যাসন্ডা ক্রেসিং’ এবং ‘সান ফ্লাওয়ার’ ছবি দুটির মাধ্যমে সোফিয়া লরেন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেলেন। সোফিয়া লরেন একটা সময় মনে করতেন, মহিলাদের আকর্ষণ বাড়ায় নারীত্ব আর যৌন আবেদন। সোফিয়া লরেন এক সময় হলিউডে অ্যাপার্টমেন্ট করে সেটেল্ড হয়ে যান। কিন্তু নিজ দেশ ইতালির কথা ভুলতে পারেননি বলে রোম শহরে একটা বাড়িও করেছিলেন। প্রতি বছর এক মাসের জন্য এসে সেই বাড়িতে থেকে গেছেন। এতটা সুন্দরী না হয়েও সোফিয়া লরেন চলচ্চিত্রে যোগ দিয়ে ঝড় তুলেছিলেন। মডেল গার্ল হিসেবেও তিনি বেশ এগিয়েছিলেন। তার অভিনীত ‘টু ও ম্যান’ এবং ‘সান ফ্লাওয়ার’ ছবি দুটি এক সময় ঢাকার অভিজাত প্রেক্ষাগৃহগুলোয় রিলিজ হয়েছিল। তখন এ ছবি দুটি দেখার জন্য দর্শকের প্রচণ্ড ভিড় জমেছিল প্রেক্ষাগৃহের সামনে। সে কথা কী ভোলার! তিনি হলিউডের ছবিতে অভিনয় করে রীতিমত হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তির তারকা। তার ঐশ্বর্য-খ্যাতি এখনও যে ভোলার নয়।