পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২১, ২০১১

ঢাকার ফিল্মের রাজপুত্তুর রাজ্জাক

১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করার পর রাজ্জাকের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নায়ক হিসেবে এ ছবিতে অভিনয় করলেও এর আগে তিনি অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে এ পর্যন্ত রাজ্জাক ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন তারকার পক্ষে এতগুলো ছবিতে অভিনয় করা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। ঢাকার ছবিতে রাজ্জাকই প্রথম তারকা প্রথা চালু করেছিলেন। তিনি যখন ছবিতে নায়ক ছিলেন তখন সর্বশ্রেণীর মানুষ ছবি দেখত। তার অভিনীত ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, জীবন থেকে নেয়া, অবুঝ মন, প্রতিনিধি দর্শকরা বার বার দেখেছে। পুরনোরা নয়, এ প্রজন্মের দর্শকরাও রাজ্জাককে বলেন ‘নায়করাজ’। তাই তো তিনি জীবদ্দশায় কিংবদন্তির তারকা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। রাজ্জাক একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার নাগতলায়। কিশোর বয়স থেকে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চনাটকে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে পড়ার সময় ‘রতন লাল বাঙালী’ নামে একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার কারণে স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে দেখা করেন। তারই সহায়তায় যোগ দেন ইকবাল ফিল্মস লিমিটেডে। এখানে মাসে সামান্য বেতন পেতেন। পাশাপাশি মঞ্চ ও টেলিভিশনে নাটক করে যা পেতেন তা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালাতেন। ১৯৬৫ সালে ইকবাল ফিল্মসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিচালক কামাল আহমদের সহকারী হলেন। সে সময় দুই-তিনটি ছবিতে তিনি অতিরিক্ত শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার পর থেকে রাজ্জাকের যথার্থ উত্থান ঘটে। ছবিটি মুক্তির পর দলে দলে দর্শক ছবিঘরে ভিড় করে। কোনো কোনো প্রেক্ষাগৃহে ‘বেহুলা’ একটানা ছয় মাস পর্যন্তও প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘বেহুলা’ মুক্তির পর চলচ্চিত্র প্রযোজকরা দীর্ঘদিন পর একজন সুদর্শন নায়কের দেখা পেলেন। যে জন্য ছবি নির্মাতারা ছবি নির্মাণের জন্য তখন থেকেই রাজ্জাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠল। ১৯৬৬ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সুজাতা, সুচন্দা ও কবরীর বিপরীতেই তিনি বেশি অভিনয় করেছেন। ওই সময়ের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংসার, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, টাকা আনা পাই, মধু মিলন, জীবন থেকে নেয়া, দর্পচূর্ণ প্রভৃতি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ রাজ্জাকের জীবনে এক স্মরণীয় ছবি। ছবিটি রিলিজের পর গুলিস্তান ছবিঘরে ছবিটি দেখেছিলেন তিনি। ছবির নির্মাতা জহির রায়হান সাহেব এর আগে ‘বেহুলা’ আর ‘আনোয়ারা’ ছবিতে অভিনেতাকে নিয়েছিলেন। তার পরিচালিত প্রতিটি ছবি ছিল জীবনবোধে উজ্জীবিত শিল্পধর্মী। জহির রায়হানই সার্বিক অর্থে গণমানুষের রাজনীতি ও বাঁচার সংগ্রামকে সেলুলয়েডে চিত্রায়ন করে গেছেন। সত্তর দশকের প্রথম দিক থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল তার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। প্রতিদিনই তাকে ২০ ঘণ্টা করে সময় দিতে হতো ছবির কাজে। তার অভিনীত অধিকাংশ ছবিই ছিল ব্যবসায়িক দিক দিয়ে দারুণ সফল। ঢাকার প্রথম স্বীকৃত অ্যাকশনধর্মী ছবি ‘রংবাজ’-এ এই রাজ্জাকই প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ঢাকায় প্রথম এসে কমলাপুরে নিম্নমানের এক বাসায় রাজ্জাককে বাসা ভাড়া করে কোনোভাবে দিন কাটাতে হয়েছিল। সেই রাজ্জাক নিজের অক্লান্ত চেষ্টা, ত্যাগ আর ধৈর্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু বছর ধরে তিনি কোটিপতি। পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে থাকেন গুলশানের লক্ষ্মীকুঞ্জে। কয়েকবার তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনিই। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সাবেক শুভেচ্ছা দূতও ছিলেন। তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি হলো—আকাঙ্ক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, আপনজন, মৌচোর, বদনাম, সত্ ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বৌ, জীনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির প্রভৃতি। রাজ্জাকের পথ ধরেই তার দুই ছেলে বাপ্পা রাজ ও সম্রাট ফিল্মের নায়ক হয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই রাজ্জাকের অতীত সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। ১৯৭২ থেকে ’৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—স্লোগান, আমার জন্মভূমি, অতিথি, কে তুমি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, প্রিয়তমা, পলাতক, ঝড়ের পাখি, খেলাঘর, চোখের জলে, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ভাইবোন, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, গুণ্ডা, আগুন, মতিমহল, অমর প্রেম, যাদুর বাঁশী, অগ্নিশিখা, বন্ধু, কাপুরুষ, অশিক্ষিত, সখি তুমি কার, নাগিন, আনারকলি, লাইলী মজনু, লালু ভুলু, স্বাক্ষর, দেবর ভাবী, রাম রহিম জন, আদরের বোন, দরবার, সতীনের সংসার প্রভৃতি। চলচ্চিত্রই তাকে দিয়েছে সহায়-সম্পত্তি, সুনাম-খ্যাতি। আর এজন্যই রাজ্জাক এখনও রয়েছেন ফিল্মের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছরই নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে একটি করে ছবিও উপহার দিচ্ছেন। রাজ্জাক একটা যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এই তো সেদিনও ফিল্মে ছিল তার আকাশছোঁয়া খ্যাতি। আর এ জন্যই ঢাকার ফিল্মে তিনিই প্রথম ও সর্বশেষ রাজপুত্তুর।