পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২১, ২০১১

ফেরদৌসী রহমান সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী

ফেরদৌসী রহমানের গান এক সময় বাংলা ছবিতে শুধু জনপ্রিয়তা ও সাফল্যই দেয়নি, দিয়েছিল এক ধরনের সুরমগ্ন মাদকতাও। ‘মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছিনু নিতে’, ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার’, ‘বিধি বইসা বুঝি নিরালে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘মনে হলো যেন এই নিশি লগনে’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে এক সময়ে তার জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল প্রায় অচল। ফিল্মে গান করা ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হয়। অথচ তার গাওয়া অতীতের সেই সব গান আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে থাকল। আর এ জন্য সঙ্গীত ভুবনে ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তি। জন্ম তার ১৯৪১ সালের ২৮ জুন। সে হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের বয়স প্রায় সত্তর। এ বয়সে তিনি মাঝে মধ্যে সঙ্গীতবিষয়ক আলোচনা সভা, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সঙ্গীত সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবেও তিনি উপস্থিত হচ্ছেন হঠাত্ হঠাত্। ফেরদৌসী বেগম ১৯৪৬ সাল থেকে বেতারে গান করা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। একটু বড় হয়েই রেকর্ডে—‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’ গান খানি গাইলেন। এই গান দিয়েই তিনি বাঙালি শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেলেন। সিনেমার গানে প্রথম কণ্ঠ দেন ১৯৫৮ সালে ‘আসিয়া’ ছবিতে। তবে ‘আসিয়া’ ছবিটি একটু বিলম্বে মুক্তি পাওয়ার কারণে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘এ দেশ তোমার আমার’। এটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এ ছবিতে ফেরদৌসী বেগম গেয়েছিলেন, ‘চুপিসারে এত করে কামিনী ডাকে’ গানখানি। ফেরদৌসী রহমান ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফিল্মে যেসব গান করেছেন তার সবগুলো আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিন ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তার গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন। ফেরদৌসী বেগমের শিল্পী জীবনের একটি বিরাট সৌভাগ্য, তিনি এ দেশের গুণী অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল আহাদের সুর করা আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন। এছাড়া খন্দকার নুরুল আলম, আজাদ রহমান, জালাল আহমদ, আবদুল লতিফ, ওসমান খান, কানাইলাল শীল, আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ, সমর দাস, সুবল দাস, অজিত রায় প্রমুখ খ্যাতনামা সুরকারের সুরেও গান গেয়েছেন। প্রথম সুরকার হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে রবীন ঘোষও সুরকার হিসেবে ছিলেন। স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী বেগম ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘নোলক’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। আজকাল ফেরদৌসী রহমান তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাস উদ্দিন সঙ্গীত একাডেমির পেছনেও বেশ সময় দিচ্ছেন। এই একাডেমিকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গাওয়া গানগুলো তার মনে আগের মতোই নাড়া দেয়। শুধু তার অন্তরে নয়, এ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীরাও আবার গাইছেন আব্বাস উদ্দিনের গান। বিয়ের পরেই (১৯৬৬ সালে) ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তার দুই ছেলে রুবাইয়াত আর রাজন আজ প্রতিষ্ঠিত। ওরা যে যার সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এ বয়সে সময় পেলে বিদেশে ছেলেদের কাছে তিনি বেড়াতে যান। নবীন শিল্পীদের লোকসঙ্গীত গাইবার ব্যাপারে উত্সাহ দেয়া ছাড়াও শিশু-কিশোরদের বহু বছর ধরে তিনি গান শিখিয়ে আসছেন। এভাবেই একের পর এক কাজ নিয়ে ফেরদৌসী রহমান এখনও ব্যস্ত। বিদেশি গান গাইবার স্মৃতি এখনও তার মনে নাড়া দেয়। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান একবার জানিয়েছিলেন, ১৯৬৩ সালের কথা এখনও আমার বারবার মনে পড়ে। সে বছর আমি ও লায়লা আরজুমান্দ বানু দু’জনে একত্রে মস্কোয় গিয়ে গান করেছিলাম। এককভাবে এক অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম ‘ও মোর চান্দোরে ও মোর সোনারে’ গানটি। এ গান শেষ হতেই প্রচুর হাততালি শুরু হলো, আমি তো গান গেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু হাততালি থামছে না চলছেই। পরে লোকজন আমাকে টেনেটুনে আবার স্টেজে পাঠাল। তখন বুঝলাম এই হাততালি মানে আরও গান গাইতে হবে এবং তাই করলাম। চীনে গান গাইতে গেলাম ১৯৬৬ সালে। চৌ এন লাই তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী। তার সামনে গাইলাম ‘চুং ফাং হোং’ গানটা। এটি ছিল চীনা ভাষার গান। এ গান শুনে প্রধানমন্ত্রী আমার প্রশংসা করে বললেন, তুমি তো চীনা ভাষা জানো না। এতো দরদ দিয়ে গাইলে কীভাবে? তিনি বারবার আমার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। সেই কবেকার ঘটনা, যা আজও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। ফেরদৌস শব্দের অর্থ স্বর্গীয়। ফেরদৌসী শব্দের অর্থ ‘শ্রবণের স্বর্গ’। বাস্তবে অর্থাত্ শিল্পী জীবনেও তাই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তিনি এ দেশের সিনেমার গান প্রথম জনপ্রিয় করে গেছেন। সিনেমার স্বর্ণযুগের শিল্পী তিনিই। তার প্রতিটি গানই ফেরদৌসী রহমানকে স্মরণে আনবে দীর্ঘকাল।