পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২২, ২০১১

আনোয়ার হোসেন : সিনেমার মুকুটহীন সম্রাট

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার পর আনোয়ার হোসেন যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানেই দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে গেলেন একবার। এক লোক দৌড়ে এসে বললেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১২ বার দেখেছি। নওগাঁর এক লোক বললেন, ৫০ বার নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেখে ছেলের নাম রেখেছি—‘আনোয়ার হোসেন’। হাইকোর্ট মাজারে গেলেন আনোয়ার হোসেন। এক রিকশাওয়ালা মালা কিনে তার গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার জীবন আজ সার্থক হয়েছে। লাহোরে এক ছবির শ্যুটিং করার জন্য গেলেন তিনি, সেখানে এক চাষী হাল ছেড়ে সোজা দৌড়ে এসে আনোয়ার হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাঙাল কা নওয়াব বাঙাল কা নওয়াব’। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিটির মাধ্যমে তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন। বাঙালি চিরদিন তাকে বলবেন—এ যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালে জামালপুরের সরুলিয়া গ্রামে। পিতা নাজির হোসেন ছিলেন জামালপুরের সাব-রেজিস্ট্রার। শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বেশ ক’বছর কেটেছে তার জামালপুরে। ১৯৫১ সালে জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে মঞ্চ নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। রাতভর মঞ্চে হিরোর পাঠ করতেন। ময়মনসিংহ ছেড়ে একসময় ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকা বেতারের নাটকে প্রথম অভিনয় শুরু ১৯৫৭ সালে। নাটকটির নাম ছিল নওফেল হাতেম’। আনোয়ার হোসেন অভিনীত প্রথম ছবি—‘তোমার আমার’। মহিউদ্দিন পরিচালিত এ ছবিতে তিনি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মোঃ আনিস নামে তখনকার এক ফিল্মের সহকারী পরিচালক তাকে প্রথম ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ‘সূর্যস্নান’ তার দ্বিতীয় ছবি। এটি মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। এরপর অভিনয় করলেন— জোয়ার এলো (১৯৬২), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), নাচঘর (১৯৬৩), দুই দিগন্ত (১৯৪৬), বন্ধন (১৯৬৪), একালের রূপকথা (১৯৬৫) প্রভৃতি ছবিতে। ‘দুই দিগন্তে’ তাঁর নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী। ১৯৬৪ সালের ১ মে ‘দুই দিগন্ত’ ছবিটি দিয়ে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহের শুভ উদ্বোধন হয়েছিল। রোজির সঙ্গে ওই সময় বন্ধন, একালের রূপকথা ছবি দুটিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে সাতরং (উর্দু ছবি) ছবিতে ট্রাক ড্রাইভার চরিত্রে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। নায়িকা সুলতানা জামান তার ট্রাকে এসে আশ্রয় নেন। ওকে ছোট বোন হিসেবে গ্রহণ করলেন। পরে হারুনের সঙ্গে সুলতানা জামানের বিয়ে দিয়ে একখানা কোরআন শরীফ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজা সন্ন্যাসী’ ছবিতে তাকে সন্ন্যাসী প্রশান্তের চরিত্রে অভিনয় করে ধূতি পরতে হয়েছিল। সন্ন্যাসী সেজেছিলেন সুজাতা। ছবিতে সুজাতাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন তিনি। এরপর উর্দু ছবি ‘উজালা’য় নায়ক হিসেবে অভিনয় করলেন। তার নায়িকা ছিলেন সুলতানা জামান। ‘উজালা’ মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে বাংলা ও উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে কাজ করার পর আনোয়ার হোসেনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছবির চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেই সারা বাংলাদেশের লোকজন তাকে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ বলে চিনতে-জানতে শুরু করল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এরপর ‘অপরাজেয়’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা ছিলেন সুজাতা। ‘পরশমণি’তে সাহিত্যিক হিসেবে অভিনয় করেন। ‘শহীদ তিতুমীর’ এবং ‘ঈশা খাঁ’ ছবি দুটিতে তিনি নাম ভূমিকায় ছিলেন। ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’ ছবির শ্যুটিং করার জন্য ১৯৬৭ সালে লাহোরে গেলেন। ছবিতে তিনি রাজার ভূমিকায় ছিলেন। ‘জাহা বাজে শেহ্ নাই’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। নায়ক হিসেবে তার শেষ ছবি ‘সূর্য সংগ্রাম’। নায়িকা ছিলেন রোজি। ১৯৬৭ সালে ‘রাখাল বন্ধু’তে ছিলেন রাজা। আবির্ভাবে ডাক্তার। ‘তুম মেরে হোতে’ চরিত্রাভিনেতা, ‘গৌরীতে’ খলনায়ক, ‘এতটুকু আশা’য় রোজির নায়ক ছিলেন তিনি। গৌরীতে উপজাতিদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছেন তিনি। নায়ক-নায়িকা ছিলেন রহমান ও নাসিমা খান। ‘পালঙ্ক’ তার জীবনের এক স্মরণীয় ছবি। রাজেন তরফদার পরিচালিত ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। তার অসাধারণ অভিনয় দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিল। শুধু কি তাই, বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত্ রায় ‘পালঙ্ক’ ছবিতে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই তো ক’বছর আগেও আনোয়ার হোসেন বাবা, দাদা, চাচা ইত্যাদির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অসুস্থতা ও বয়সের কারণে এখন আর তিনি অভিনয় করতে পারছেন না। বহু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেলেন ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫) ছবির জন্য। ওই ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তে সহ-অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেলেন ১৯৭৮ সালে। এরও আগে ১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’য় অভিনয় করে নিগার পুরস্কার পেয়েছিলেন। অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই ১৯৮৮ সালে প্রথম একুশে পদক পান।