পৃষ্ঠাসমূহ

মে ১৪, ২০১১

রুনা লায়লা

লাহোরের ফিল্মের গানে তখনও খ্যাতির তুঙ্গে নূরজাহান, সেই ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। তখন রুনা লায়লার বয়স বছর পনের হবে। উঠতি বয়সে উর্দু ও পাঞ্জাবি ছবির গানে কণ্ঠ দেয়া সবে শুরু। ফিল্মের গানে হঠাত্ জড়িয়ে অল্পদিনের মধ্যেই তোলপাড় সৃষ্টি করলেন। ধীরে ধীরে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত। সেই ক্ষণে ১৯৬৮ সালে ঢাকার সুরকার সুবল দাস রুনা লায়লাকে দিয়ে প্রথম ‘স্বরলিপি’ ছবিতে গান করালেন। গানটি ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে।’ ডুয়েট এ গানের অপর শিল্পী ছিলেন মাহমুদুন্নবী। এ কথা তো আজ ইতিহাস। এই গানের সুরকার সুবল দাস আর কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবী আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন রুনা লায়লা। আজও রুনা লায়লা সমানে গান গেয়ে চলছেন। ফিল্মে, স্টেজে, চ্যানেলে এমনকি বিদেশে। গাইছেন তো গাইছেনই। ঈশ্বর প্রদত্ত এ কণ্ঠের প্রশংসা করেছিরেন এক সময় সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানও।
শত শত কালজয়ী গান গেয়ে রুনা লায়লা এখন কিংবদন্তি। রুনা লায়লার সঙ্গীত জীবন শুরু হয়েছিল করাচি থেকে। তখন তার বাবা ওখানে চাকরি করতেন বলে করাচি ও লাহোরে তাকে অনেক বছর থাকতে হয়েছিল। উর্দু ছবিতে যখন গান গাওয়া শুরু করেন তখন নূরজাহান প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে খ্যাতির শীর্ষেই ছিলেন। নূরজাহান মারা যাওয়ার আগে করাচিতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন রুনা লায়লা। তার কাছ থেকে রুনা লায়লা মায়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছিলেন। সে কথা এতদিন বাদেও তিনি সম্ভবত ভোলেননি। ভোলার কথাও নয়। কেননা রুনা লায়লার খ্যাতি প্রথম করাচি ও লাহোর থেকে শুরু হয়েছিল।
১৯৭৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রুনা লায়লা ঢাকার বাংলা গানে এক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, সেই সাম্রাজ্য আজও টলেনি। কত শিল্পী এলেন-গেলেন, কতজনই তো আছেন। কিন্তু একজন রুনা লায়লা কি সৃষ্টি হয়েছেন? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। একটা সময় ছিল, ঢাকার ফিল্মের গানে রুনা লায়লা একচ্ছত্র রাজত্ব করেছিলেন। এখনও সমানে চলছে রুনা লায়লার যুগ এবং আজ পর্যন্ত চিত্রগীতি ধারাবাহিকতায় তিনিই চূড়ান্ত উত্কর্ষের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। ফিল্মের লোকজন রুনা লায়লাকে দিয়ে এক সময় একচেটিয়া গান করিয়েছিলেন। রুনাকে দিয়ে বেশি গান গওয়ানো হয় কেন? এ প্রশ্ন তুলতেই একবার সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক ও সুরকাররা একবাক্যে বলেছিলেন, ‘কম সময়ের মধ্যে তিনি গান সম্পন্ন করে দিতে পারেন। তাকে একবার বুঝিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার সুর বোঝাতে হয় না। যার জন্য রুনা লায়লাকে দিয়ে বেশি গান করাই। তার কণ্ঠের যে তুলনা নেই।’
রুনা লায়লার জন্ম ১৯৫২ সালে। প্রথম দিকের পাঁচ বছর বাদ দিলে দেখা যাবে তিনি ৫৪ বছর ধরে সঙ্গীত সাধনায় নিমগ্ন। তিনি সর্বদাই সঙ্গীতের ধ্যানে মগ্ন। লাখো লাখো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে তিনি এগিয়ে আছেন। দেশ থেকে দেশান্তরে গান গেয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র রুনা লায়লার গান শোনার জন্য এখনও যে দর্শকদের বিনিদ্র রজনী কাটে। সঙ্গীতের প্রতি অসাধারণ অনুরাগ ও নিষ্ঠার জন্য তিনি পরিবার থেকেও উত্সাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কণ্ঠশিল্পী হওয়ার জন্য মা-বাবা দু’জনই তাকে উত্সাহ দিয়েছিলেন।
অল্প বয়স থেকেই স্টেজে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনি। পাশাপাশি করাচি রেডিওতেও গান গাইতেন রুনা। সঙ্গে থাকতেন তার মা। ১৯৬৬ সালের দিকে সিনেমার গান গাওয়ার জন্য মায়ের সঙ্গে করাচি থেকে লাহোরে যেতেন। ১৯৬৭ সালের কথা। ‘দাইয়ারে দাইয়ারে দাইয়া’ গানটি গেয়ে করাচি, লাহোর, কোয়েটা, পেশোয়ারে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকার লোকজনও তার গান শুনে এক সময় জানতে পারল, রুনা লায়লা যে বাঙালি মেয়ে। অল্পদিনের মধ্যে নজরুল ইসলামের ছবি ‘স্বরলিপি’ মুক্তি পাওয়ার পর সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল রুনা লায়লারই গাওয়া ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে।’ এভাবে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল তার নামধাম। অবশ্য এর আগেই ‘জুগনু’ ছবিতে মনজুর হোসেনের সুরে ‘গায় ছে মুন্নি ছে’ গেয়ে লাহোর ও করাচিতে তার জনপ্রিযতা শুরু হয়েছিল। নিসার বাজমির সুরে ‘নায় না তারাশ কে রেহে গায়া’ এবং সোহেল রানার সুরে ‘হ্যায় মেরি হিয়ে দোয়া তুম সালামাত রাহো’ গান দুটি তার জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রুনা লায়লা নিজেকে শুধু সঙ্গীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১৯৯৭ সালের ১৬ মে রুনা লায়লা নায়িকা হিসেবে ‘শিল্পী’ ছবিতে আলমগীর, দোদুল ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন। রুনা লায়লার ব্যক্তিগত জীবন ঘিরে ‘শিল্পী’ ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছিল। লাহোরের উর্দু ছবিতে রুনা লায়লার গান সফল হয়েছিল চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন ও অডিওতে এ পর্যন্ত তিনি ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার গাওয়া শ্রোতানন্দিত উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে—‘অনেক বৃষ্টি ঝড়ের পরে তুমি এলে’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’, ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’, ‘বুকে আমার আগুন জ্বলে’, ‘যাদু বিনা পাখি’, ‘একটু খানি দেখ একখান কথা রাখ’, ‘আইলো দারুণ ফাগুনরে’, ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল’, ‘পাহাড়ি ফুল আমি মৌরানী’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’, ‘আমার অনেক ঋণ আছে’ প্রভৃতি আরও কত কী সব! তিনি একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক মেয়েসন্তানের জননী। মেয়ে তানি লায়লাও একজন সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী।