পৃষ্ঠাসমূহ

জুন ১৫, ২০১১

স্বর্ণযুগের কণ্ঠশিল্পী মান্না দে

ক্যাপশন যুক্ত করুন
প্রায় নব্বইয়ের কাছে বয়স এখন মান্না দে’র। এ পর্যন্ত তিনি গেয়েছেন সাড়ে তিন হাজার গান। স্ত্রীসহ থাকেন ভারতের কর্নাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে। এ বয়সেও রোজ ঘড়ি ধরে ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর রেওয়াজে বসে যান। সে পর্ব চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। রেওয়াজ থেকে উঠে টুকটাক ঘরের কাজ করেন। বাংলা, ইংরেজি সব ধরনের পত্র-পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। খুব আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট, ফুটবল, গলফ খেলাও দেখেন। প্রতিদিন দুপুরে ঘুমান। বিকালে অনুষ্ঠান না থাকলে তিনি গান নিয়ে বসেন। এ বয়সেও গান ছাড়া তিনি যেন কিছুই বোঝেন না।
‘তুমি আর ডেকো না পিছু ডেকো না আমি চলে যাই, শুধু বলে যাই তোমার হৃদয়ে মোর স্মৃতি রেখো না আঁখিজল কবু ফেল না...’ এই গান কোথাও বেজে উঠলে পথচলা লোকজন এখনও থমকে দাঁড়ান। তাদের যে শুনতে হবে পুরো গানটি। শুনতেই যে হবে—‘নিবিড় আঁধারে একা নিবু দ্বীপ আর জ্বেল না পথ আর চেয়ে থেকো না/জানি মোর কিছু রবে না তোমার আমার দেখা এ জীবনে আর হবে না—আমার এ চলে যাওয়া চেয়ে দেখো না, অকারণে ব্যথা পেয়ো না হারালে যাহারে আজ তারে আর ফিরে চেয়ে দেখো না। বেদনায় হাসিতে ডেকো না পিছু ডেকো না।’... গানের এ কথাগুলোও।
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে। পিতা পূর্ণচন্দ্র দে তিন ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন বড়। মধ্যম হেমচন্দ্র দে আর মান্না দে’র কনিষ্ঠ কাকা হলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে। মান্না দে’র মাতার নাম মহামায়া দেবী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে মান্না দে পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। বড় ভাই প্রণব দে এক সময় বাংলার অন্যতম প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। দ্বিতীয় ভাই প্রকাশ চন্দ্র দে একজন চিকিত্সক ছিলেন। ছোট ভাই প্রভাষ চন্দ্র দে গান-বাজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তাদের মধ্যে মান্না দে বেশি নামধাম করেছেন। শৈশব জীবন তার কেটেছে কলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকেই আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কাকা কৃষ্ণচন্দ্রই মান্না দে’র সঙ্গীতানুশীলনে প্রথম প্রেরণা। সঙ্গীত পরিবারে জন্ম বলেই পরিবেশ ও জন্মগত প্রতিভা মান্না দেকে সঙ্গীতানুশীলনে এক সময় কৃতকার্যতার পথে নিয়ে যায়। প্রথম দিকে তার বাবা ও কাকা ছেলেদের কোনো দিনই সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় যোগদান করার অনুমতি দিতেন না। কিন্তু সমবয়সী অনেককেই বিচিত্রানুষ্ঠানে বিভিন্ন পদকে পুরস্কৃত হতে দেখে মান্না দে খানিকটা মনে মনে আঘাত পেতেন। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগদান করে যখন পুরস্কার পেলেন তখন খুশিতে মন ভরে ওঠে। সেটা ছিল ১৯৩২-৩৩ সালের কথা। ১৯৩৭ সালে মান্না দে ইন্টার কলেজিয়েট সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত থেকেও পদক নিয়েছিলেন। সঙ্গীতে তার হাতে খড়ি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের হাতে। ১৯৪১ সালের ২০ ডিসেম্বর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গে মান্না দে বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান। সেখানে গিয়ে কাকার সঙ্গে লক্ষ্মী প্রোডাকশনে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছবির নাম ছিল ‘তামান্না’ এবং ‘মেরা গাঁও’। পরে সঙ্গীত পরিচালক হরিপ্রসন্ন দাসের সহকারী হিসেবে ‘মহব্বত’ ও ‘কাদম্বরী’ ছবিতে কাজ করেন। এক সময় লক্ষ্মী প্রোডাকশন ত্যাগ করে ফিল্মস্থানে যোগ দিয়ে ‘মজদুর’ এবং ‘বেগম’ চিত্রে সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। পুনরায় লক্ষ্মী প্রোডাকশনে যোগদান করেন এবং ‘বীরাঙ্গনা’ ও ‘সতীতোরান’ ছবিতে সহকারী সঙ্গীত পরিচালকরূপে কাজ সম্পন্ন করলেন। ওই দুই ছবিতে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে গানও গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে শচীন দেব বর্মণের সহযোগী হিসেবে ‘মশাল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রথম ফণী মজুমদার পরিচালিত ‘তামান্না’ ছবিতে (১৯৫০ সালে) সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়া ‘গণেশ জনম’, ‘সুখ রম্ভা’, ‘শিব কন্যা’, ‘জয় মহাদেব’ প্রভৃতি ছবিরও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মান্না দে।
‘রাম রাজ্য’ ছবিতে (১৯৪৯ সালে) মান্না দে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এই ছবিতে তিনি ৭টি গান করে ছিলেন। বিশেষ করে বাল্মীকির গানগুলো। বিক্রমাদিত্য, অমরভূপালি, মা, দো বিঘা জমিন, পরিণীতা, সুরঙ্গ, ঝনক ঝনক পায়েল বাজে, আওয়ারা, বুটপালিশ, মহাত্মা, সীমা, হামদরদ প্রভৃতি হিন্দি ছবিতে মান্না দে’র গানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে মান্না দে বিয়ে করেন সুলোচনা দেবীকে। তিনি অবাঙালি হলেও মান্না দে’র জন্য কোনো অসুবিধা হয়নি। আজ অবধি তারা সুখের সংসার করে যাচ্ছেন। এখনকার গান সম্পর্কে মান্না দে’র অভিমত—‘এখন গান নিয়ে ছ্যাবলামো চলছে। যারা গাইছেন, তাদের কোনও শিক্ষাদীক্ষা নেই। গলায় সুর নেই। তাই এসব গান মর্মস্পর্শী হয় না।’ সঙ্গীতকে ভালোবাসেন এমন যে কেউ বলবেন, তার এ মন্তব্য যথার্থই। যে জন্য এখনও শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন মান্না দে’র গাওয়া ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ কিংবা হেমন্তের আকাশ আজি মেঘলা’, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘রানার রানার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ আরও কত কী সব কালজয়ী গান।