পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২৭, ২০১১

নাট্যগুরু আসকার ইবনে শাইখ

আসকার ইবনে শাইখ একাধারে নাট্যকার, গীতিকার, সংগঠক, অভিনেতা, গাল্পিক, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাসৈনিক, ইতিহাসবেত্তা ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। পূর্ব-বাংলার মুসলিম সমাজজীবননির্ভর প্রথম নাটক ‘বিরোধ’ রচনা করেন তিনি। নাটকটি সে আমলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকের মধ্য দিয়ে আসকার ইবনে শাইখ পথিকৃত নাট্যকারের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
আসকার ইবনে শাইখের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। আসকার ইবনে শাইখ তার লেখক নাম এবং এ নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। শাইখের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ মার্চ মোমেনশাহী জেলার গৌরীপুর থানার মাইজহাটি গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই নাটকের প্রতি ছিল তার দুর্দমনীয় আকর্ষণ। শাইখ মোমেনশাহী জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি জড়িত হন ভাষা আন্দোলনের পথিকৃত সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে। এ সংগঠন থেকে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের পাশাপাশি প্রকাশ হতো মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্যুতি’। এ পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন আসকার ইবনে শাইখ। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর।
পেশায় শিক্ষক হলেও নাটকের নেশায় তিনি ছিলেন সারাজীবন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এদেশের আধুনিক নাট্যজগতের ভিত্তিভূমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন আসকার ইবনে শাইখ। নাটক রচনা, নাট্য সংগঠন পরিচালনা, নির্দেশনা, অভিনয়সহ নাটকের সব ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরণ। মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা সব মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। পূর্ববাংলার গণমানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল আসকার ইবনে শাইখের নাটক। জননেতা মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন তিনি। মওলানা ভাসানী আসকার ইবনে শাইখের নাটককে মূল্যায়ন করতেন ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। যে জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল সে জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্রই পরিদৃষ্ট ছিল শাইখের নাটকে। ফলে মওলানা তাকে দেখতেন গণমানুষের জীবনের রূপকার হিসেবে।
আসকার ইবনে শাইখ রচনা করেছেন বিপুল সংখ্যক নাটক। শুধু সামাজিক নয়, এদেশের মানুষের গোটা ইতিহাসকেও তিনি রূপান্তর করেছেন তার নাট্যকর্মে। আজও অনবদ্য অক্ষয় হয়ে আছে তার কীর্তি ‘রাজ্য-রাজা-রাজধানী’। এদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসও হয়ে উঠেছে তার নাটকের উপজীব্য, লিখেছেন ‘কন্যা-জায়া-জননী’। এ দুটি বিশেষ নাট্যক্রম বাংলা নাটকের ইতিহাসে পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এছাড়াও তার নাটক পদক্ষেপ (১৯৪৮), বিদ্রোহী পদ্মা (১৯৪৮), দুরন্ত ঢেউ (১৯৫১), শেষ অধ্যায় (১৯৫২), অনুবর্তন (১৯৪৩), বিল বাঁওড়ের ঢেউ (১৯৫৫), এপার ওপার (১৯৫৫), প্রতীক্ষা (১৯৫৭), প্রচ্ছদপট (১৯৫৮), লালন ফকির (১৯৫৯), অগ্নিগিরি (১৯৫৮), তিতুমীর (১৯৫৭), রক্তপদ্ম (১৯৫৭), অনেক তারার হাতছানি, (১৯৫৭), কর্ডোভার আগে (১৯৮০), রাজপুত্র (১৯৮০), মেঘলা রাতের তারাসহ (১৯৮৭) অধিকাংশ নাটকই ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘদিন তিনি তার নিজবাসায় একটানা নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজটি করেছেন একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। যার ফলে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন। আসকার ইবনে শাইখ পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যকার, অভিনেতা ও কলা-কুশলীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি কিংবদন্তি নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রথম নাটক ‘বাসন’ও সাক্ষ্য দেয় সেলিম কীভাবে শাইখের উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছেন। শাইখ তার মেধা-প্রতিভা, সৃজনক্ষমতা ও দায়বোধের প্রকাশ এমনভাবে ঘটিয়েছেন যে, সেই পঞ্চাশের দশক থেকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে তিনিই ছিলেন এদেশের নাট্যগুরু। এই সর্বজন স্বীকৃত নাট্যগুরু ইন্তেকাল করেন ২০০৯ সালের ১৮ মে রাজধানীতে তার নিজ বাসভবনে।
এদেশের মুসলিম সমাজজীবনে বিশেষ করে নগরকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষিত একশ্রেণীর সংস্কৃতিসেবীর ওপর সেকুলারিজমের ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এক সময় ধীরে ধীরে আসকার ইবনে শাইখ নামটি আড়ালে পড়ে যায়। কেননা সেকুলাররা মনে করেন শাইখের নাম উচ্চারিত হলেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছুটে আসবে। ফলে মৃত্যুর পূর্বে প্রায় দেড়-দুই দশক তিনি অনেকখানি অন্তরালে চলে যান। কিন্তু তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সে ইতিহাস জীবদ্দশায়ই তাকে পরিণত করে কিংবদন্তিতে। বর্তমানে তার নাটক ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তেমন কোনো তত্পরতা না থাকলেও এটা অসম্ভব নয় যে, এদেশের জনগণ একদিন তার সৃষ্টিকর্মকে নবজাগরণের হাতিয়ার বানিয়ে তুলবে এবং যে মহত্ তত্পরতায় তিনি তুলে এনেছেন জীবন ও ইতিহাসের বিচিত্র দৃশ্যাবলী তার যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

এপ্রিল ২২, ২০১১

ফার্স্ট লেডি সুমিতা দেবী

ঢাকার ছবির প্রথম দিককার নায়িকা হলেন সুমিতা দেবী। সুমিতা দেবী অভিনীত ‘আকাশ আর মাটি’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই। এই ছবিটি তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে প্রথম। তবে তিনি ‘আসিয়া’ ছবিতে প্রথম কাজ শুরু করেন। ‘আসিয়া’য় তার নায়ক ছিলেন শহীদ। ১২টির মতো ছবিতে সুমিতা নায়িকা ছিলেন। তাকে বলা হয় ঢাকার ফিল্মের প্রথম ফার্স্ট লেডি। ফিল্মে যোগ দিয়ে তার নাম হয়েছিল সুমিতা দেবী। আসল নাম তার ‘হেনা’। ১৯৩৫ সালে ঢাকার মানিকগঞ্জে তার জন্ম। ১৯৪৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে হেনা ঢাকায় চলে এলেন। এসেই বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে হেনা পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে কিছুদিন ছিলেন, এরপর কলকাতায় ফিরে আসতেই হেনার বিয়ে হয়ে গেল অতুল লাহিড়ির সঙ্গে। হেনা থেকে হয়ে গেলেন হেনা লাহিড়ি। ওদের এ বিয়ে বেশিদিন টিকল না। ১৯৫৭ সালে হেনা ফিরে এলেন ঢাকায়। এদিকে ঢাকায় ছবি নির্মাণ হচ্ছে শুনে হেনার ইচ্ছে জাগল তিনিও ফিল্মে অভিনয় করবেন। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে এ ছবিতে তার অভিনয় করা সম্ভব হয়নি। পরে ওই চরিত্রটি করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে তৃপ্তি মিত্র। ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ ছবিতে হেনা নাম পাল্টিয়ে ‘সুমিতা দেবী’ নামে প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন তিনি। তবে ‘আসিয়া’ রিলিজের আগেই নায়িকা সুমিতা দেবীর ‘আকাশ আর মাটি’ এবং ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে তার দুই নায়ক ছিলেন। তারা হলেন—আমিন ও প্রবীর কুমার। ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে সুমিতার বিপরীতে ছিলেন আনিস। এ ছবি দুটিতে সুমিতা ও আনিস বিভিন্ন রোমান্টিক দৃশ্যে অংশ ছাড়াও কয়েকটি গানের দৃশ্যে ছিলেন। মাহাবুবা রহমানের গাওয়া সুমিতা দেবীর লিফে—‘নয়নে লাগলো যে রঙ আহা তা কেউ জানলো না’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতেই ছিল এই গানটি। ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়। নায়ক ছিলেন শহীদ। আসিয়া ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের গাওয়া—‘মেঘে দেওয়ায় করছে মেঘলী তোলাইল পূবাল বাও’ গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। ছবিতে তার প্রেমিক শহীদ। কিন্তু ছবির কাহিনী অনুযায়ী শহীদের চাচা কাজী খালেকের সঙ্গে সুমিতার বিয়ে হয়। প্রেমিকা সুমিতা হয়ে গেলেন প্রেমিক শহীদের চাচী। এটা দুজনে মেনে নিতে পারেননি। যে জন্য শেষতক ওদের সহমরণ হয়েছিল। নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবীর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আরও রয়েছে—সোনার কাজল (১৯৬২, নায়ক খলিল), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩, নায়ক আনোয়ার হোসেন), এই তো জীবন (১৯৬৪, নায়ক রহমান), দুই দিগন্ত (১৯৬৪, নায়ক আনোয়ার হোসেন), ধূপ ছাঁও (১৯৬৪, নায়ক এজাজ), জনম জনম কি পিয়াসি (১৯৬৮), সঙ্গম (১৯৬৩, নায়ক খলিল), অশান্ত প্রেম (১৯৬৮, নায়ক হায়দার শফী)। এ দেশ তোমার আমার ছবি সম্পর্কে সুমিতা দেবী তার জীবদ্দশায় জানিয়েছিলেন, এ ছবির সবচেয়ে সার্থক অংশ হলো সঙ্গীত। আমার সহশিল্পী দাগু বর্ধন জমিদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি প্রতিটি দৃশ্যে আশ্চর্য অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। নায়ক আনিস বিশেষ করে তার দীপ্ত মুখখানা এখনও আমার চোখে ভাসে। অভিনয় গুণে তিনি নায়ক চরিত্র সার্থক করেছিলেন। সুভাষ দত্ত, রহমান, মেসবাহ প্রমুখ অভিনেতাও ‘এ দেশ তোমার আমার ছবিতে ছিলেন। রহমান ছিলেন খলনায়ক। বাঙালি মেয়ে সুমিতা দেবী এক সময় ঢাকা থেকে লাহোরে গেলেন উর্দু ছবিতে অভিনয় করার জন্য। অবশ্য তার আগে সাতক্ষীরার মেয়ে স্মৃতি রেখা বিশ্বাস লাহোরের ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। লাহোরে গিয়ে সুমিতা ‘ধূপছাঁও’ ছবিতে অভিনয় করেন। ওই ছবিতে তার নায়ক ছিলেন নায়িকা-গায়িকা নূরজাহানের স্বামী এজাজ। ‘ধূপছাঁও’ ছবিটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে সুমিতা দেবী নায়িকা চরিত্র ছেড়ে দিয়ে মা, খালা, ভাবীর চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৯ সালের শেষদিকে ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে তারা একে অপরকে মন দিয়ে বসলেন। তারপর দু’জনে গোপনে কোর্টে গিয়ে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তারা প্রায় ৮ বছর ধরে সুখের সংসার করেন। এরপর তার স্বামী জহির রায়হান আবারও বিয়ে করার কারণে সুমিতা দেবীর জীবনে দুঃখ নেমে আসে। সুমিতা দেবী কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মায়ার সংসার, আদর্শ ছাপাখানা, নতুন প্রভাত, আগুন নিয়ে খেলা, মোমের আলো প্রভৃতি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় থাকাকালীন সুমিতা দেবী উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘শ্রী শ্রী সত্য শাহী বাবা’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন। ৮০ ভাগ শুটিং শেষে ছবির কাজ আর হলো না। সুমিতা দেবী মারা যান ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি। ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘আকাশ আর মাটি’, ‘এই তো জীবন’ প্রভৃতি ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করে সুমিতা দেবীও কিংবদডিন্ত হয়ে রইলেন।

আনোয়ার হোসেন : সিনেমার মুকুটহীন সম্রাট

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার পর আনোয়ার হোসেন যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানেই দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে গেলেন একবার। এক লোক দৌড়ে এসে বললেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১২ বার দেখেছি। নওগাঁর এক লোক বললেন, ৫০ বার নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেখে ছেলের নাম রেখেছি—‘আনোয়ার হোসেন’। হাইকোর্ট মাজারে গেলেন আনোয়ার হোসেন। এক রিকশাওয়ালা মালা কিনে তার গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার জীবন আজ সার্থক হয়েছে। লাহোরে এক ছবির শ্যুটিং করার জন্য গেলেন তিনি, সেখানে এক চাষী হাল ছেড়ে সোজা দৌড়ে এসে আনোয়ার হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাঙাল কা নওয়াব বাঙাল কা নওয়াব’। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিটির মাধ্যমে তিনি কিংবদন্তী হয়ে রইলেন। বাঙালি চিরদিন তাকে বলবেন—এ যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালে জামালপুরের সরুলিয়া গ্রামে। পিতা নাজির হোসেন ছিলেন জামালপুরের সাব-রেজিস্ট্রার। শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বেশ ক’বছর কেটেছে তার জামালপুরে। ১৯৫১ সালে জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে মঞ্চ নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। রাতভর মঞ্চে হিরোর পাঠ করতেন। ময়মনসিংহ ছেড়ে একসময় ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকা বেতারের নাটকে প্রথম অভিনয় শুরু ১৯৫৭ সালে। নাটকটির নাম ছিল নওফেল হাতেম’। আনোয়ার হোসেন অভিনীত প্রথম ছবি—‘তোমার আমার’। মহিউদ্দিন পরিচালিত এ ছবিতে তিনি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মোঃ আনিস নামে তখনকার এক ফিল্মের সহকারী পরিচালক তাকে প্রথম ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ‘সূর্যস্নান’ তার দ্বিতীয় ছবি। এটি মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। এরপর অভিনয় করলেন— জোয়ার এলো (১৯৬২), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), নাচঘর (১৯৬৩), দুই দিগন্ত (১৯৪৬), বন্ধন (১৯৬৪), একালের রূপকথা (১৯৬৫) প্রভৃতি ছবিতে। ‘দুই দিগন্তে’ তাঁর নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী। ১৯৬৪ সালের ১ মে ‘দুই দিগন্ত’ ছবিটি দিয়ে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহের শুভ উদ্বোধন হয়েছিল। রোজির সঙ্গে ওই সময় বন্ধন, একালের রূপকথা ছবি দুটিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে সাতরং (উর্দু ছবি) ছবিতে ট্রাক ড্রাইভার চরিত্রে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। নায়িকা সুলতানা জামান তার ট্রাকে এসে আশ্রয় নেন। ওকে ছোট বোন হিসেবে গ্রহণ করলেন। পরে হারুনের সঙ্গে সুলতানা জামানের বিয়ে দিয়ে একখানা কোরআন শরীফ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজা সন্ন্যাসী’ ছবিতে তাকে সন্ন্যাসী প্রশান্তের চরিত্রে অভিনয় করে ধূতি পরতে হয়েছিল। সন্ন্যাসী সেজেছিলেন সুজাতা। ছবিতে সুজাতাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন তিনি। এরপর উর্দু ছবি ‘উজালা’য় নায়ক হিসেবে অভিনয় করলেন। তার নায়িকা ছিলেন সুলতানা জামান। ‘উজালা’ মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে বাংলা ও উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে কাজ করার পর আনোয়ার হোসেনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছবির চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেই সারা বাংলাদেশের লোকজন তাকে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ বলে চিনতে-জানতে শুরু করল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এরপর ‘অপরাজেয়’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা ছিলেন সুজাতা। ‘পরশমণি’তে সাহিত্যিক হিসেবে অভিনয় করেন। ‘শহীদ তিতুমীর’ এবং ‘ঈশা খাঁ’ ছবি দুটিতে তিনি নাম ভূমিকায় ছিলেন। ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’ ছবির শ্যুটিং করার জন্য ১৯৬৭ সালে লাহোরে গেলেন। ছবিতে তিনি রাজার ভূমিকায় ছিলেন। ‘জাহা বাজে শেহ্ নাই’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। নায়ক হিসেবে তার শেষ ছবি ‘সূর্য সংগ্রাম’। নায়িকা ছিলেন রোজি। ১৯৬৭ সালে ‘রাখাল বন্ধু’তে ছিলেন রাজা। আবির্ভাবে ডাক্তার। ‘তুম মেরে হোতে’ চরিত্রাভিনেতা, ‘গৌরীতে’ খলনায়ক, ‘এতটুকু আশা’য় রোজির নায়ক ছিলেন তিনি। গৌরীতে উপজাতিদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছেন তিনি। নায়ক-নায়িকা ছিলেন রহমান ও নাসিমা খান। ‘পালঙ্ক’ তার জীবনের এক স্মরণীয় ছবি। রাজেন তরফদার পরিচালিত ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। তার অসাধারণ অভিনয় দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিল। শুধু কি তাই, বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত্ রায় ‘পালঙ্ক’ ছবিতে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই তো ক’বছর আগেও আনোয়ার হোসেন বাবা, দাদা, চাচা ইত্যাদির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অসুস্থতা ও বয়সের কারণে এখন আর তিনি অভিনয় করতে পারছেন না। বহু পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেলেন ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫) ছবির জন্য। ওই ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তে সহ-অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেলেন ১৯৭৮ সালে। এরও আগে ১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’য় অভিনয় করে নিগার পুরস্কার পেয়েছিলেন। অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই ১৯৮৮ সালে প্রথম একুশে পদক পান।

এপ্রিল ২১, ২০১১

ফেরদৌসী রহমান সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী

ফেরদৌসী রহমানের গান এক সময় বাংলা ছবিতে শুধু জনপ্রিয়তা ও সাফল্যই দেয়নি, দিয়েছিল এক ধরনের সুরমগ্ন মাদকতাও। ‘মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছিনু নিতে’, ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার’, ‘বিধি বইসা বুঝি নিরালে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘মনে হলো যেন এই নিশি লগনে’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে এক সময়ে তার জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল প্রায় অচল। ফিল্মে গান করা ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হয়। অথচ তার গাওয়া অতীতের সেই সব গান আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে থাকল। আর এ জন্য সঙ্গীত ভুবনে ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তি। জন্ম তার ১৯৪১ সালের ২৮ জুন। সে হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের বয়স প্রায় সত্তর। এ বয়সে তিনি মাঝে মধ্যে সঙ্গীতবিষয়ক আলোচনা সভা, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সঙ্গীত সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবেও তিনি উপস্থিত হচ্ছেন হঠাত্ হঠাত্। ফেরদৌসী বেগম ১৯৪৬ সাল থেকে বেতারে গান করা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। একটু বড় হয়েই রেকর্ডে—‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’ গান খানি গাইলেন। এই গান দিয়েই তিনি বাঙালি শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেলেন। সিনেমার গানে প্রথম কণ্ঠ দেন ১৯৫৮ সালে ‘আসিয়া’ ছবিতে। তবে ‘আসিয়া’ ছবিটি একটু বিলম্বে মুক্তি পাওয়ার কারণে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘এ দেশ তোমার আমার’। এটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এ ছবিতে ফেরদৌসী বেগম গেয়েছিলেন, ‘চুপিসারে এত করে কামিনী ডাকে’ গানখানি। ফেরদৌসী রহমান ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফিল্মে যেসব গান করেছেন তার সবগুলো আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিন ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তার গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন। ফেরদৌসী বেগমের শিল্পী জীবনের একটি বিরাট সৌভাগ্য, তিনি এ দেশের গুণী অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল আহাদের সুর করা আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন। এছাড়া খন্দকার নুরুল আলম, আজাদ রহমান, জালাল আহমদ, আবদুল লতিফ, ওসমান খান, কানাইলাল শীল, আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ, সমর দাস, সুবল দাস, অজিত রায় প্রমুখ খ্যাতনামা সুরকারের সুরেও গান গেয়েছেন। প্রথম সুরকার হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে রবীন ঘোষও সুরকার হিসেবে ছিলেন। স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী বেগম ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘নোলক’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। আজকাল ফেরদৌসী রহমান তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাস উদ্দিন সঙ্গীত একাডেমির পেছনেও বেশ সময় দিচ্ছেন। এই একাডেমিকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গাওয়া গানগুলো তার মনে আগের মতোই নাড়া দেয়। শুধু তার অন্তরে নয়, এ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীরাও আবার গাইছেন আব্বাস উদ্দিনের গান। বিয়ের পরেই (১৯৬৬ সালে) ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তার দুই ছেলে রুবাইয়াত আর রাজন আজ প্রতিষ্ঠিত। ওরা যে যার সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এ বয়সে সময় পেলে বিদেশে ছেলেদের কাছে তিনি বেড়াতে যান। নবীন শিল্পীদের লোকসঙ্গীত গাইবার ব্যাপারে উত্সাহ দেয়া ছাড়াও শিশু-কিশোরদের বহু বছর ধরে তিনি গান শিখিয়ে আসছেন। এভাবেই একের পর এক কাজ নিয়ে ফেরদৌসী রহমান এখনও ব্যস্ত। বিদেশি গান গাইবার স্মৃতি এখনও তার মনে নাড়া দেয়। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান একবার জানিয়েছিলেন, ১৯৬৩ সালের কথা এখনও আমার বারবার মনে পড়ে। সে বছর আমি ও লায়লা আরজুমান্দ বানু দু’জনে একত্রে মস্কোয় গিয়ে গান করেছিলাম। এককভাবে এক অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম ‘ও মোর চান্দোরে ও মোর সোনারে’ গানটি। এ গান শেষ হতেই প্রচুর হাততালি শুরু হলো, আমি তো গান গেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু হাততালি থামছে না চলছেই। পরে লোকজন আমাকে টেনেটুনে আবার স্টেজে পাঠাল। তখন বুঝলাম এই হাততালি মানে আরও গান গাইতে হবে এবং তাই করলাম। চীনে গান গাইতে গেলাম ১৯৬৬ সালে। চৌ এন লাই তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী। তার সামনে গাইলাম ‘চুং ফাং হোং’ গানটা। এটি ছিল চীনা ভাষার গান। এ গান শুনে প্রধানমন্ত্রী আমার প্রশংসা করে বললেন, তুমি তো চীনা ভাষা জানো না। এতো দরদ দিয়ে গাইলে কীভাবে? তিনি বারবার আমার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। সেই কবেকার ঘটনা, যা আজও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। ফেরদৌস শব্দের অর্থ স্বর্গীয়। ফেরদৌসী শব্দের অর্থ ‘শ্রবণের স্বর্গ’। বাস্তবে অর্থাত্ শিল্পী জীবনেও তাই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তিনি এ দেশের সিনেমার গান প্রথম জনপ্রিয় করে গেছেন। সিনেমার স্বর্ণযুগের শিল্পী তিনিই। তার প্রতিটি গানই ফেরদৌসী রহমানকে স্মরণে আনবে দীর্ঘকাল।

নজরুল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

নানা রকম বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন সঙ্গীত সাধনা করে ফিরোজা বেগম শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয় হয়েছেন। আশির কোঠায় এখন তার বয়স। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরু থেকে তিনি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর প্রায় সাত দশক পার হলো। এখন তিনি অসুস্থ। এরই মধ্যে তার চিকিত্সার পেছনে কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। অথচ মস্তবড় এই শিল্পীর চিকিত্সার ব্যাপারে কোনো সংগঠন বা সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। এটা দুঃখজনক। এটা ফিরোজা ভক্তদের মনে দারুণ কষ্ট দিয়েছে। ফিরোজা বেগম মানেই বাংলার গৌরব। তিনি জীবদ্দশায় হয়েছেন কিংবদন্তি। তার মতো মস্তবড় শিল্পী আমাদের দেশে আর কোথায়? তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি আজীবন সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। অসুখ অবস্থায়ও তিনি সঙ্গীত নিয়ে ভাবেন। এ রকম কি আর কেউ ভাবেন? চিত্ত রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, কমল দাস গুপ্ত, সুধীর লাল চক্রবর্তী ছাড়া আরও অনেকে তার কাছে এখনও স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি। ‘বউ কথা কও, কও কথা অভিমানিনী’—গানের এ কথা মনে হলে ফিরোজা বেগমের নামটি হৃদয়ে বার বার জেগে ওঠে যে কোনো সঙ্গীতপ্রেমিকের হৃদয়ে। উঠবেই না কেন, তিনি যত গান গেয়েছেন তার সবই তো শ্রোতাদের মনে দাগ কেটে আছে। সে জন্য ফিরোজা বেগমের গাওয়া গানগুলো বার বার শুনেও লাখো শ্রোতার মনের পিপাসা যে মিটছে না। ১৯৪২ সাল থেকে ফিরোজা বেগমের গান গাওয়া শুরু। দীর্ঘ সময়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। একটা সময়ে এসে তিনি নজরুলের গানই বেশি গাইতে লাগলেন। গান গাইতে গিয়ে তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন। যে জন্য তিনি কত শত পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ফিরোজা বেগম নজরুলের গান করেন—এ কথাই শ্রোতারা বলেন বেশি। তিনি অডিও ক্যাসেট ও সিডিতে রবীন্দ্রনাথের গানও করেছেন। তিনি গেয়েছেন অতুল প্রসাদ ও রজনী কান্তের গানও। ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯২৮ সালে ফরিদপুরে। একটু বড় হয়ে গান গাওয়ার ব্যাপারে তার পিতার গান শোনার শখ এবং মাতার গলার সুর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। ফিরোজা যখন ছিলেন কিশোরী, তখন তার কণ্ঠে গান শুনে সঙ্গীত ভুবনের গুণীজনরা বলতেন—এই মেয়ের গলায় রেকর্ড হতে পারে, এ কথা শুনে তিনি চমকাতেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি রেকর্ডে ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কৃষক চন্দ্র দে’র গান শুনতেন তন্ময় হয়ে। কিশোরী বয়সে ফিরোজা বেগমের প্রতিভা শুধু গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাঁতার, খেলাধুলা, ক্লাসিক্যাল নাচ ও গানের ক্ষেত্রে অসাধারণ বিশেষত্বে বিকশিত হয়ে ওঠেন। নাচ ও গানের জন্য স্বয়ং গুরু সদর দত্ত নিজ হাতে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। একবার কিশোরী ফিরোজা বেগম শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে ৬টি গান পরিবেশন করে ফরিদপুর শহরে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেন। সে তো ১৯৩৭ সালের কথা...। ফিরোজা বেগম মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাত্ ১৯৩৯ সালে চলে গেলেন কলকাতায়। তার বড় বোন তখন কলকাতায় সংসার করছেন। সেখানে গিয়েই উঠলেন। বিরাট শহর, তাই কলকাতায় গিয়ে গান শেখার পূর্ণ সুযোগ পেলেন। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান সহকারী সুরশিল্পী চিত্ত রায়ের কাছে প্রাথমিক পাঠ নিতে শুরু করলেন। সেখানেই তার সঙ্গে বিশিষ্ট সুরকার কমল দাস গুপ্তের প্রথম দেখা হয়। চিত্ত রায় ও কমল দাস গুপ্তের সহযোগিতায় ১৯৪২ সালে তার প্রথম দুটি গানের রেকর্ড বের হলো। গান দুটি হলো—‘মরুর বুকে জীবন ধারা কে হারালো’ এবং ‘ঠ্যায়রো ঠ্যায়রো জ্যারা’। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তিনি নিয়মিত গান করেছেন, যেমন—বেতারে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার সর্বাধিক প্রকাশিত কাগজ আনন্দবাজার তার গানের প্রশংসাও করেছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলেন। ওই বছরই ঢাকায় রেডিও স্টেশনের শর্টওয়েভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এবং তালাত মাহমুদ একত্রে গাইলেন—‘খেওয়ান হার নেইয়া মোরি ক্যার দো পার’ গানখানি। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারে নিয়মিত গান করেছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে আবার কলকাতায় চলে গেলেন ফিরোজা বেগম। সে বছরই কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে তার সুরে বেশকিছু গান করেন। এভাবেই তার সঙ্গীত গুরু হয়ে উঠলেন কমল দাস গুপ্ত। তিনি নজরুলের কথার সুর দিতেন আর ফিরোজা তা কণ্ঠে তুলে নিতেন। এভাবে প্রতিদিন তাদের দু’জনার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হতো। মনের অজান্তে একজন আরেকজনকে মন দিলেন। ১৯৫৬ সালে কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হলো। ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করে কমল দাস গুপ্ত মুসলমান হয়ে হলেন—‘কামালউদ্দিন’। ১৯৫৭ সালে কলকাতা ছেড়ে দু’জনে চলে এলেন ঢাকায়। পাকিস্তানি আমল তখন। তাই ভারতে ফিরোজা বেগমের সমস্যা, আবার ঢাকায় কমল দাস গুপ্তের সমস্যা। ঢাকায় দু’জনে ফিরে এসে বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে দু’জনে যান, সেখানে মুখের ওপর দরজা বন্ধ। এজন্য বাড়িভাড়া পেতেও বেগ পেতে হলো। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কমল দাস গুপ্ত গৃহবন্দি ছিলেন ঢাকাতেই। সেসব কাহিনী তো এখন ইতিহাস। ১৯৭৪ সালে কমল দাস গুপ্ত মারা গেলে ফিরোজা বেগম একাকী হয়ে পড়লেন সন্তানদের নিয়ে। ফিরোজা বেগম যখন দেখলেন দেশে যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না, ঠিক সেই ক্ষণে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ছুটলেন একক অনুষ্ঠান করতে। যখন যেখানে গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাই তো বলতে হয়, শ্রোতার মনে, জনগণের হৃদয়ে তার ন্যায্য আসনটি যে পেয়েছেন—তাই তার জন্য যথেষ্ট নয় কি? কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাকেও তিনি গান শুনিয়েছেন—তখন তো তার কিশোরী বয়স। নজরুলের গান গাইতে গিয়ে তিনি এক সময় দেখলেন, নজরুলের লেখা প্রতিটি গান যেন বৈচিত্র্যে ভরা। এভাবেই তিনি নজরুলের গানের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। যতই নজরুলের গানের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকেন, বিস্ময়ের মাত্রা তার ততই বেড়ে যেতে থাকে। কথা, সুর, রাগের বৈচিত্র্য, তাল, ছন্দ—সব মিলিয়ে নজরুলের গান তাকে ভাবিয়ে তোলে। আর এভাবেই অনেক চেষ্টায় ফিরোজা বেগম নজরুলের অফুরান ভাণ্ডারের কিছু আয়ত্ত করে ফেললেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড করলেন, গানটি ছিল—‘গহনে গহনে সন্ধ্যা তারা’। এরপর থেকে তিনি নজরুলের গান নিয়েই পড়ে থাকলেন। এজন্য ফিরোজা বেগমকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেদিনের জনগণ সে কথা আজও ভোলেনি। নজরুলের গানের সেমিনার করা থেকে শুরু করে নানা রকম পরিকল্পনা করে এগিয়ে ছিলেন ফিরোজা বেগম। তিনি এগিয়েও ছিলেন। এভাবে তিনি নজরুলের গানকে জনপ্রিয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। আর তারই চেষ্টাতেই নজরুলসঙ্গীত আজ জনপ্রিয়। ঘরে ঘরে এ গান বাজে। এর পেছনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে ফিরোজা বেগমেরই। ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’, ‘খেলিছে জলদেবী’, ‘বলেছিলে তুমি আসিবে’, ‘বিরহের গুলবাগে’, ‘বনের তাপসী কুমারী’, ‘তুমি শুনিতে চেও না’, ‘কথা কও, কথা কও’, ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’, ‘মোমের পুতুল মমীর’, ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম খেজুর’, ‘বনফুলে তুমি মঞ্জরি’, ‘তোমার আসার আশায়’, ‘গলে টগরমালা’, ‘যুগ যুগ ধরি’, ‘প্রভু তোমারে খুঁজিয়া মরি’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ’, ‘প্রিয়তম এত প্রেম দিও না’, ‘আমি পূরব দেশের’, ‘কে বিদেশি বন উদাসী’, ‘বনমালার ফুল’সহ নজরুলের হাজারও গান তিনি গেয়েছেন, যা কিনা সিডিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারপরও একজন শিল্পীর তৃপ্তি কী মেটে! মেটে না। তাই তো ফিরোজা বেগম আরও গাইতে চান। তিনি শিল্পী, তাই তার মন পড়ে আছে গানের পানে। গান নিয়েই তিনি আছেন, থাকবেন আগামী দিনগুলোতেও—এই প্রত্যাশা তার লাখো ভক্তের। তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তিনি জনসমক্ষে এসে আবারও গেয়ে উঠবেন নজরুলের গান—‘আমি যুগ যুগ ধরে লোকে লোকে মোর প্রভুরে খুঁজিয়া বেড়াই’সহ হাজারও গান। আর এ জন্যই ফিরোজা বেগম নজরুলসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী।

রত্না থেকে শাবানা

ঢাকার ছবিতে ১৯৬২ সালে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে শাবানার আত্মপ্রকাশ ‘রত্না’ নামে। তখন তার বয়স ছিল এগারো কি বারো। ১৯৬৬ সালে উর্দু ছবি চকোরীতে রত্না থেকে তিনি হলেন ‘শাবানা’। ১৯৭০ পর্যন্ত উর্দু ও বাংলা এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কয়েকশ’ বাংলা ছবির নায়িকা ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে শাবানা অভিনয় করেছিলেন। ফয়েজ চৌধুরী তার মেয়ে রত্নাকে নিয়ে প্রায়ই এফডিসিতে আসতেন। এহতেশাম তখন ‘নতুন সুর’ নামে একটি ছবির কাজ নিয়েছেন। সেটা ছিল ১৯৬১ সালের কথা। একজন শিশু শিল্পী দরকার—রত্নাকে দেখে এহতেশাম পছন্দ করলেন। এভাবেই ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম অভিনয় জীবন শুরু হলো তার। তবে এরও অনেক পরে ১৯৬৬ সালে ‘চকোরী’ ছবি থেকে রত্না নাম পাল্টে তার নাম রাখা হলো শাবানা। ‘শাবানা’ নামটি দিলেন এহতেশাম নিজেই। শাবানার আসল নাম ছিল আফরোজা সুলতানা। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। জন্ম ১৯৫০ সালে। নায়িকা হওয়ার আগে শাবানা শিশু অভিনেত্রী হিসেবে তালাশ, সাগর, ভাইয়া ছবিতে অভিনয় করেন। নায়িকা হিসেবে তার অভিনয় শুরু ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে (১৯৬৬)। ওই ছবিতে সোনাভানের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তার নায়ক ছিলেন কাসেম। ‘চকোরী’ ছবিতে কাজ করার আগে ‘জংলী মেয়ে’ ছবির কাজ শুরু করেন তিনি। ‘জংলী মেয়ে’ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন আজিম। ‘চকোরী’ও মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। নায়ক ছিলেন নাদিম। এই ছবিতে শাবানা ও নাদিমের অসম্ভব নাম হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে নায়িকা হিসেবে চাঁদ আওর চাঁদনী, ভাগ্যচক্র ও কুলীতে; ১৯৬৯ সালে দাগ, মুক্তি; ১৯৭০ সালে পায়েল, সমাপ্তি, ছদ্মবেশী, বাবুল, মধুমিলন এবং একই অঙ্গে এত রূপ ছবিতে অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা এগারোজন’-এ অভিনয় করেন শাবানা। ওই বছরই ‘অবুঝ মন’ ছবিতে অভিনয় করে সারাদেশে অসম্ভব খ্যাতি পেলেন। ১৯৭২ সালে এ দুটি ছবিসহ তার আরও ৬টি ছবি রিলিজ হয়। এ ছবিগুলো হলো—সমাধান, ছন্দ হারিয়ে গেল, এরাও মানুষ, মুন্না আওর বিজলী, চৌধুরী বাড়ী আর স্বীকৃতি। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো—ফকির মজনু শাহ, চাষার মেয়ে, উত্সর্গ, মায়ার বাঁধন, আগুন, সোহাগ, মাটির ঘর, বধূ বিদায়, দুই পয়সার আলতা, লালুভুলু, ভাত দে, লাল কাজল প্রভৃতি। পাকিস্তান আমলে উর্দু ছবিতে নাদিমের সঙ্গে অভিনয় করে সফল হয়েছিলেন এই শাবানা। রাজ্জাক, ওয়াসিম, আলমগীর এরাও শাবানার নায়ক ছিলেন। শাবানা একবার জানিয়েছিলেন, রাজ্জাক ও আমি জুটি হিসেবে যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ঠিক তখনই আলমগীরের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হলাম। সামাজিক ছবিতে আমরা সফল হয়েছিলাম। আমার ক্যারিয়ার গঠনে অনেক পরিচালকের অবদান রয়েছে। এহতেশাম চাচা যদি সুযোগ না দিতেন তাহলে হয়তো ‘শাবানা’ হতে পারতাম না। সামাজিক চরিত্রে নতুন ইমেজে আমাকে পরিচিত করার ব্যাপারে কাজী জহির, মমতাজ আলী, কামাল আহমেদ-এর অবদান কোনো দিন মন থেকে সরে যাবে না। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শাবানা ঢাকার ফিল্মে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কয়েকশ’ ছবির নায়িকা ছিলেন। পোশাকী, সামাজিক, অ্যাকশন সব ছবিতেই তিনি সফল হয়েছিলেন। তার অভিনীত উল্লেম্লখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে—চকোরী (১৯৬৭), জংলী মেয়ে (১৯৬৭), চাঁদ আওর চাঁদনী (১৯৬৭), কুলি (১৯৬৮), পায়েল (১৯৬৯), ছদ্মবেশী (১৯৭০), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৭০), ওরা এগারোজন (১৯৭২), মুন্না আওর বিজলী (১৯৭২), অবুঝ মন (১৯৭২), দস্যুরানী (১৯৭৩), মালকা বানু (১৯৭৪), দুই রাজকুমার (১৯৭৫), অনেক প্রেম অনেক জ্বালা (১৯৭৫), জীবন সাথী (১৯৭৬), রাজ দুলারী (১৯৭৮), বধূ বিদায় (১৯৭৮), কাপুরুষ (১৯৭৮), ফকির মজনু শাহ (১৯৭৮), আয়না (১৯৭৯), চোখের মণি (১৯৭৯), বিজয়িনী সোনাভান (১৯৭৯), সাথী তুমি কার (১৯৮০), দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), লাল কাজল (১৯৮২), বানজারান (১৯৮৩), মরণের পরে (১৯৮৯), কাজের বেটি রহিমা (১৯৯১), স্বামীর আদেশ (১৯৯১), অন্ধ বিশ্বাস (১৯৯২) প্রভৃতি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় শাবানা চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। তা প্রায় ১৮ বছর হয়ে এল। তবুও শাবানা নামটি এখন পর্যন্ত দর্শকের মুখে মুখে থেকে গেল। আর এ জন্যই শাবানা ঢাকার ফিল্মে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।

ঢাকার ফিল্মের রাজপুত্তুর রাজ্জাক

১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করার পর রাজ্জাকের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। নায়ক হিসেবে এ ছবিতে অভিনয় করলেও এর আগে তিনি অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে এ পর্যন্ত রাজ্জাক ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন তারকার পক্ষে এতগুলো ছবিতে অভিনয় করা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। ঢাকার ছবিতে রাজ্জাকই প্রথম তারকা প্রথা চালু করেছিলেন। তিনি যখন ছবিতে নায়ক ছিলেন তখন সর্বশ্রেণীর মানুষ ছবি দেখত। তার অভিনীত ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, জীবন থেকে নেয়া, অবুঝ মন, প্রতিনিধি দর্শকরা বার বার দেখেছে। পুরনোরা নয়, এ প্রজন্মের দর্শকরাও রাজ্জাককে বলেন ‘নায়করাজ’। তাই তো তিনি জীবদ্দশায় কিংবদন্তির তারকা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। রাজ্জাক একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার নাগতলায়। কিশোর বয়স থেকে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চনাটকে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে পড়ার সময় ‘রতন লাল বাঙালী’ নামে একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার কারণে স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে দেখা করেন। তারই সহায়তায় যোগ দেন ইকবাল ফিল্মস লিমিটেডে। এখানে মাসে সামান্য বেতন পেতেন। পাশাপাশি মঞ্চ ও টেলিভিশনে নাটক করে যা পেতেন তা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালাতেন। ১৯৬৫ সালে ইকবাল ফিল্মসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিচালক কামাল আহমদের সহকারী হলেন। সে সময় দুই-তিনটি ছবিতে তিনি অতিরিক্ত শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার পর থেকে রাজ্জাকের যথার্থ উত্থান ঘটে। ছবিটি মুক্তির পর দলে দলে দর্শক ছবিঘরে ভিড় করে। কোনো কোনো প্রেক্ষাগৃহে ‘বেহুলা’ একটানা ছয় মাস পর্যন্তও প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘বেহুলা’ মুক্তির পর চলচ্চিত্র প্রযোজকরা দীর্ঘদিন পর একজন সুদর্শন নায়কের দেখা পেলেন। যে জন্য ছবি নির্মাতারা ছবি নির্মাণের জন্য তখন থেকেই রাজ্জাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠল। ১৯৬৬ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সুজাতা, সুচন্দা ও কবরীর বিপরীতেই তিনি বেশি অভিনয় করেছেন। ওই সময়ের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংসার, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, টাকা আনা পাই, মধু মিলন, জীবন থেকে নেয়া, দর্পচূর্ণ প্রভৃতি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ রাজ্জাকের জীবনে এক স্মরণীয় ছবি। ছবিটি রিলিজের পর গুলিস্তান ছবিঘরে ছবিটি দেখেছিলেন তিনি। ছবির নির্মাতা জহির রায়হান সাহেব এর আগে ‘বেহুলা’ আর ‘আনোয়ারা’ ছবিতে অভিনেতাকে নিয়েছিলেন। তার পরিচালিত প্রতিটি ছবি ছিল জীবনবোধে উজ্জীবিত শিল্পধর্মী। জহির রায়হানই সার্বিক অর্থে গণমানুষের রাজনীতি ও বাঁচার সংগ্রামকে সেলুলয়েডে চিত্রায়ন করে গেছেন। সত্তর দশকের প্রথম দিক থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল তার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। প্রতিদিনই তাকে ২০ ঘণ্টা করে সময় দিতে হতো ছবির কাজে। তার অভিনীত অধিকাংশ ছবিই ছিল ব্যবসায়িক দিক দিয়ে দারুণ সফল। ঢাকার প্রথম স্বীকৃত অ্যাকশনধর্মী ছবি ‘রংবাজ’-এ এই রাজ্জাকই প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ঢাকায় প্রথম এসে কমলাপুরে নিম্নমানের এক বাসায় রাজ্জাককে বাসা ভাড়া করে কোনোভাবে দিন কাটাতে হয়েছিল। সেই রাজ্জাক নিজের অক্লান্ত চেষ্টা, ত্যাগ আর ধৈর্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু বছর ধরে তিনি কোটিপতি। পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে থাকেন গুলশানের লক্ষ্মীকুঞ্জে। কয়েকবার তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনিই। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সাবেক শুভেচ্ছা দূতও ছিলেন। তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি হলো—আকাঙ্ক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, আপনজন, মৌচোর, বদনাম, সত্ ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বৌ, জীনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির প্রভৃতি। রাজ্জাকের পথ ধরেই তার দুই ছেলে বাপ্পা রাজ ও সম্রাট ফিল্মের নায়ক হয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই রাজ্জাকের অতীত সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। ১৯৭২ থেকে ’৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—স্লোগান, আমার জন্মভূমি, অতিথি, কে তুমি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, প্রিয়তমা, পলাতক, ঝড়ের পাখি, খেলাঘর, চোখের জলে, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ভাইবোন, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, গুণ্ডা, আগুন, মতিমহল, অমর প্রেম, যাদুর বাঁশী, অগ্নিশিখা, বন্ধু, কাপুরুষ, অশিক্ষিত, সখি তুমি কার, নাগিন, আনারকলি, লাইলী মজনু, লালু ভুলু, স্বাক্ষর, দেবর ভাবী, রাম রহিম জন, আদরের বোন, দরবার, সতীনের সংসার প্রভৃতি। চলচ্চিত্রই তাকে দিয়েছে সহায়-সম্পত্তি, সুনাম-খ্যাতি। আর এজন্যই রাজ্জাক এখনও রয়েছেন ফিল্মের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছরই নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে একটি করে ছবিও উপহার দিচ্ছেন। রাজ্জাক একটা যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এই তো সেদিনও ফিল্মে ছিল তার আকাশছোঁয়া খ্যাতি। আর এ জন্যই ঢাকার ফিল্মে তিনিই প্রথম ও সর্বশেষ রাজপুত্তুর।

সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ সোহরাব হোসেন

নদীয়ার নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নামে আজও চলে বন্দনা। সেই নদীয়া জেলার আয়েশতলা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন একটি ফুটফুটে সুন্দর ছেলে। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন—‘সোহরাব’। তার বাড়ির পাশে ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ি। সারাদিন ঢাকঢোল-বাদ্য বাজতো আর কীর্তন গানে মুখরিত থাকত জমিদারবাড়ি। ছেলেটি প্রায় দিনই ছুটে আসত, কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে তার মনেও ইচ্ছে জাগল—কী করে গাইব। পরবর্তী সময়ে রেকর্ডে ও রেডিওতে গান গাইবার সুযোগ পেলেন ছেলেটি। এভাবে নাম হয়ে গেল সোহরাব হোসেনের। ঘরে ঘরে বাজতে লাগল তার কণ্ঠে গাওয়া—‘মোহাম্মদ মোর নয়নমণি মোহাম্মদ নাম জপমালা’। এ গান দিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন মস্ত বড় শিল্পী। কণ্ঠশিল্পী সোহরাব হোসেনের বয়স এখন প্রায় ৯০। এই বয়সেও সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত তিনি। এখন তো আর আগের মতো করে গাইতে পারেন না। তবে এ প্রজন্মের শিল্পীদের যথাসাধ্য সঙ্গীতের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তার খ্যাতি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদকও পেয়েছেন তিনি। দেশ তাকে যথাসাধ্য মর্যাদাও দিয়েছে। যে জন্য সোহরাব হোসেনের কোনো ক্ষোভ কিংবা দুঃখ থাকার কথা নয়। জীবনের পড়ন্ত বেলার দিনগুলো মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গীত বিচারক হিসেবে বিভিন্ন চ্যানেলে, নজরুল একাডেমিতে ডাক পড়লেও এ বয়সে সেভাবে আর যেতে পারছেন না। তবুও মাঝে মধ্যে ইচ্ছে পূরণ করছেন। সোহরাব হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল আয়েশতলা গ্রামে। ওই জায়গা এখন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় রয়ে গেছে। মাত্র ৫ বছর বয়সে নানা তমিজউদ্দিন মিয়ার কণ্ঠে—‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানখানি শুনেই সঙ্গীতের প্রতি দুর্বল হন। তারপর থেকে ঘরে বসে আপন মনে গান গাইতেন। বাড়ির কাছেই ছিল জমিদারদের বাগান। গান শেখার জন্য প্রতিদিন রাতে যেতেন সেখানে। তখনকার সমাজ এটা মেনে নিতে পারেনি। গান গাইতে দেখলেই তখন তিরস্কার করা হতো। মুসলমানের ছেলে হয়ে গান করার কারণে সোহরাব হোসেনকে অনেক গালমন্দের সঙ্গে বাধা-বিপত্তি সহ্য করতে হয়েছিল। নানা রকমের কথাও শুনতে হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে, গান-বাজনা হারাম। সোহরাব হোসেন ওইসব কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি ভাবতেন, আব্বাসউদ্দিন, কে মল্লিক—ওরা মুসলমান হয়ে যদি গান গাইতে পারেন তাহলে আমি কেন পারব না! গান তিনি ছাড়েননি। প্রথম গান শেখেন জয়নাল আবেদিনের কাছে। এরপর কিরণ দে চৌধুরীর কাছে। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বেতারে সঙ্গীত পাবলিসিটিতে সোহরাব হোসেনের চাকরি হয়। ওই সময় তিনি আব্বাসউদ্দিন আহমদ ও গিরিন চক্রবর্তীর কাছে কিছুদিন গান শিখলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রায়ই নাটক দেখতে যেতেন। উদ্দেশ্য ছিল—ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালাসহ তখনকার নামিদামি শিল্পীদের কণ্ঠে গান শোনা। তাদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে মুগ্ধ হতেন। ধীরে ধীরে গানে পারদর্শী হলেন। আর এভাবে একদিন কলকাতা বেতারে ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে গান করার সুযোগ পেলেন। সেটা ছিল ১৯৪৬ সালের কথা। উপমহাদেশ ভাগাভাগির পর আর কলকাতায় থাকা হলো না তার। ১৯৪৮ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে এইচএমভি থেকে সোহরাব হোসেনের একটি রেকর্ড বের হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বেশি হয়নি সোহরাব হোসেনের। তিনি এ প্রসঙ্গে জানিয়ে ছিলেন, নজরুল ইসলামের কণ্ঠে মাত্র দু’বার স্টেজে গান শুনেছি। ১০ কি ১১ বছর বয়সে তাকে রানাঘাট স্টেশনে প্রথম দেখি। কলকাতায় যখন যাওয়া-আসা শুরু করি তখন তার সঙ্গে দেখা হওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। সবুর খান, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন, গিরিন চক্রবর্তী—এরা একত্রে মেলামেশা করতেন। দূর থেকে দেখেছি, কিন্তু তাদের ধারে-কাছে যেতে কেমন জানি লজ্জা বা সঙ্কোচ লাগত। কেননা, উনারাতো কতই না নামিদামি ব্যক্তি! সোহরাব হোসেন এক সময় চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক করেছেন। মাটির পাহাড়, এ দেশ তোমার আমার, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল, যে নদী মরুপথে প্রভৃতি ছবিতে গেয়েছেন স্মরণীয় কিছু গান। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই সব গানের কথা এখন আর সোহরাব হোসেনের খুব একটা মনে পড়ে না। তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন লুত্ফর রহমান, ওসমান খান, মমতাজ আলী খান, আবদুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ। এরা আজ আর কেউই বেঁচে নেই। এই বয়সে সোহরাব হোসেনের খুব করে মনে পড়ে—নদীয়ার সেই দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে প্রিয় বন্ধুদের কথা। কিন্তু তিনি বলেন, অতীত ভেবে আর তো লাভ হবে না। যে দিন চলে গেছে সেদিন তো আর ফিরে আসবে না...। সোহরাব হোসেনের ৫ ছেলেমেয়ে। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে রওশন আরা সোমা থাকে কাতারে, মেজ মেয়ে রাহাত আরা গীতি ঢাকাতেই থাকে, সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত। ৯০ বছর বয়সেও তিনি কণ্ঠে তারুণ্য ধরে রেখেছেন, যা অনেকেই পারেন না। সঙ্গীতে নিবেদিত প্রবাদ-পুরুষ সোহরাব হোসেনও জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে রইলেন।

ট্রাজেডি কিং দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার...। ভারতীয় অভিনয় জগতে এক বিশাল মহীরুহ, এক জীবন্ত ইতিহাস। তার অবদান কোনো দিন ভোলা যাবে না। ‘আন’ ছবিতে নাদিরার সঙ্গে, ‘মোঘল-এ-আজম’ ছবিতে মধুবালার সঙ্গে, ‘দেবদাস’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে, ‘দাগ’ ছবিতে নিমির সঙ্গে, ‘মেলা’ ছবিতে নার্গিসের সঙ্গে, ‘আজাদ’ ছবিতে মীনা কুমারীর সঙ্গে, ‘জুগনু’ ছবিতে নূর জাহানের সঙ্গে এবং ‘গঙ্গা-যমুনা’ ছবিতে বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে দিলীপ কুমারের অভিনয়ের কথা দর্শকরা হয়তো চিরকাল মনে রাখবে। সেই দিলীপ কুমারের বয়স এখন নব্বই। যিনি একদা দিলীপ কুমারের ছবি দেখতেন, পরবর্তী সময়ে তার ছেলে আর এখন তার নাতিরাও দিলীপ কুমারের ছবি দেখেন বড় আগ্রহ নিয়ে। গিনেজ বুকেও তার নাম উঠেছে। অভিনয় করে কত যে পুরস্কার পেয়েছেন তার হিসাব নেই। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন ২০ বছর বয়স্ক সায়রা বানুকে। ১৯৬৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। এখনও তারা একই বাড়িতে রয়ে গেছেন। বৃদ্ধ দিলীপ কুমারের দিন কাটে এখন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বই-পুস্তক পড়ে। এ বয়সে খুব প্রয়োজন না হলে আর বের হন না। বহু বছর ধরে তিনি মুম্বাইর পালি হিলের বিশাল বাংলো বাড়িতে বসবাস করছেন। দিলীপ ও সায়র এখন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পড়ন্ত বেলায় দিলীপের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কতই না স্মৃতিময় ঘটনা, যা তিনি আর কোনো দিনই ফিরে পাবেন না। দিলীপ কুমারের আসল নাম ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে এক গোঁড়া মুসলিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা গোলাম সারওয়ার খানের ১২ সন্তানের মাঝে দিলীপ ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ফলের ব্যবসা করতেন। তাদের ফলের দোকান থেকে সুদূর নাগপুর, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, চেন্নাই, ভুপাল প্রভৃতি বড় বড় শহরে ফল চালান করা হতো। ছয় বছর বয়সে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে দিলীপ কুমার পেশোয়ার ছেড়ে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে এলেন। দিলীপ কুমার নামটি তার তখনও হয়নি ‘ইউসুফ’ কিংবা লাল বলে সবাই ডাকত। মুম্বাইর দিওলালির আঞ্জুমান-ই-ইসলাম স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে উইলসন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজে এসে পড়াশোনায় দিলীপের মন কিছুতেই বসতে চাইল না। বইয়ের চেয়ে বরং হাজার গুন পছন্দ হলো তার ফুটবল খেলা। যখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেন, তখন তিনি ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ঠিক করলেন আর পড়বেন না। কিছুদিন ফলের ব্যবসায় নেমে দিলীপ মোটেই আনন্দ পেলেন না। তাই ব্যবসা ছেড়ে চাকরির উদ্দেশে রওনা হয়ে যান পুনায়। সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে ম্যানেজারের পদে ৩৫ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন। এত অল্প মাইনেতেও তিনি ধৈর্য হারাননি। তিন মাস যাওয়ার পর ৩৫ টাকা থেকে তার মাসিক আয় দাঁড়াল আটশ’ টাকাতে। বেশ কিছু টাকা জমিয়ে এবার তিনি অফিসারদের মেসে একটা বার খুলে বসলেন। বেশ লাভবান হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু দিন পর বার উঠে গেল। এরপর ব্যবসা গুটিয়ে বম্বেতে ফিরে এসে কিছুদিন থাকার পর নৈনিতালে বেড়াতে গেলেন। সে সময় তার এক বন্ধু তাকে চিত্র নায়িকা দেবিকা রানীর কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেবিকা রানী তখন বম্বে টকিজের কন্ট্রোলার অব প্রোডাকশন পদে বহাল ছিলেন। দিলীপকে দেখেই তিনি বম্বে টকিজের আগামী ছবি জোয়ার ভাটায় অভিনয়ের জন্য মনোনীত করে বসলেন। ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে তাকে দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকায় নেয়া হয়েছিল। ইউসুফ খান নাম পাল্টে ছবিতে তার নাম রাখা হলো ‘দিলীপ কুমার’। সেদিন এ নামটি দিয়েছিলেন দেবিকা রানীই। বম্বে টকিজের আর্টিস্ট হয়ে তিনি মাসিক বেতন পেতেন ৬২৫ টাকা। ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। এ ছবিতে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মনে বিশেষ দাগ না কাটতে না পারলেও জনতা জানল দিলীপ কুমার নামে একজন নতুন নায়ক এসেছেন। দিলীপের দ্বিতীয় ছবি ‘প্রতিমা’। এ ছবিতেই তিনি সর্ব প্রথম একক নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। নায়িকা ছিলেন স্বর্ণলতা। তৃতীয় ছবি ‘মিলন’-এ তার সঙ্গে ছিলেন রঞ্জনা ও মীরা মিশ্র। ১৯৪৫ সালে শহীদ ছবিতে অভিনয়ের পর থেকে দিলীপের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শহীদ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। এর পর তারা জুটি হিসেবে নদীয়া কে পার, আরজু ও শবনম ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগেই নায়িকা-গায়িকা নূর জাহানের বিপরীতে দিলীপ অভিনয় করলেন জগনু ছবিতে। এরপর একে একে আরও অনেক নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করলেন ঘর কি ইজ্জত, বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, দিদার, হালচাল, দাগ, আন, সংদীল প্রভৃতি ছবিতে। ঘর কি ইজ্জত-এ তার নায়িকা ছিলেন মমতাজ শান্তি। নার্গিসের সঙ্গে বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, আন্দাজ, দিদার, জোগন প্রভৃতিতে অভিনয় করেন। এক সময় নার্গিসের সঙ্গে দিলীপের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজ কাপুরের জন্য তা বেশি দূর আগাতে পারেনি। ১৯৪৯ সালের কথা—সংদীল ছবিতে নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাষ্ট হলেন দিলীপ ও মধুবালা। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই এরা একে অন্যকে ভালোবাসলেন। মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান ওদের প্রেমের কথা জেনে ক্ষেপে গেলেন। মধুবালাকে বেশ মারধরও করলেন। পরবর্তী সময়ে দিলীপ ও মধুবালার মধ্যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য হয় এবং ওদের প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫৪ সালে। দিলীপ ও মধুবালা জুটির তারানা, সংদীল, মোঘল-এ আজম ছবি তিনটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। মোঘল-এ আজম, ভারতবর্ষের ফিল্ম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৬০ সালে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ছবিঘরে দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছিল। বাংলা ছবি সাগিনা মাহাতোতে অভিনয় করার জন্য ১৯৬৭ সালে দিলীপ কুমার কলকাতায় এসেছিলেন। এ ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সায়রা বানু। তখন তো সায়রা বানু তার স্ত্রী। ১৯৮৬ সালে দিলীপ কুমার আসমা বেগম নামে এক মহিলার প্রেমে জড়িয়ে পড়ার কারণে সায়রার সঙ্গে সম্পর্কে কিছুদিন ফাটল দেখা দেয়। পরে সায়রার মা নাসিমা বানুর হস্তক্ষেপে দিলীয় ও আসমার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে সেসব রচনার অবসান ঘটিয়েছিলেন। ইন মানিয়াত্, আন্দাজ, জোগন, দাগ, দিদার ছবিতে দিলীপ ছিলেন বিয়োগান্তক চরিত্রে। এসব ছবিতে তার অভিনয় প্রাণবন্ত হয়েছিল আর এ জন্যই দর্শকরা তাকে বলতো ট্র্যাজেডি কিং কিংবদন্তির এই তারকার ছবিগুলো ভিডিও সিডির বদৌলতে দর্শকরা এখনও ঘরে বসে দেখে থাকেন। ১৯৪৩ থেকে এ পর্যন্ত দিলীপ কুমার অভিনীত ছবির সংখ্যা ৭৮টি। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রথম ছবি ক্রান্তি ১৯৭৯। তার অভিনীত প্রতিটি ছবিই উল্লেখযোগ্য অর্থাত্ স্মরণীয়। কেননা তিনি একত্রে ১০টি কী ১২টি ছবি হাতে নিতেন না। বছরে ১টি বা ২টি ছবি হাতে নিতেন। যে জন্য তিনি চরিত্রের গভীরে যেতে পারতেন। এ কারণে শুধু সেদিনের দর্শকদের স্মৃতিতে নয়, একালের দর্শকদেরও ভালো লাগে তার অভিনীত মেলা, আন্দাজ, নদীয়াকে পাড়, বাবুল, দিদার, তারানা, নয়া দৌড়, দিলদিয়া দর্দলিয়া, সংঘর্ষ, দেবদাস, মিলন, জুগনু, মোঘল-এ আজম, পানসহ প্রতিটি ছবি।

এপ্রিল ১৮, ২০১১

অ ম র শি ল্পী আবদুল আলীম

১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিতে মাঝির গান—‘আমি ভিন গেরামের নাইয়া’ রুপালি পর্দায় এই গানের দৃশ্য দেখে হাজারও দর্শক-শ্রোতা গানের শিল্পী আবদুল আলীমের প্রশংসা করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রুপালি পর্দার আর রেকর্ডের গানে তার অসম্ভব খ্যাতি ছিল। মঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনেও তিনি ছিলেন ব্যস্ত। পল্লীসঙ্গীত গেয়ে তিনি বাঙালির হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিলেন। তার গাওয়া ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘রুপালি নদীরে’, ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল’, ‘ভাটির গাঙে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাওরে বন্ধু’, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’, ‘তেরে ইস নাদিয়ানে মুঝকো কেয়া কেয়া রঙ্গ দেখায়ে কিতনে রঙ রঙিলে মাঝি গুজরে পাল উড়ায়ে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’—এরকম কত শত গান এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। পল্লীগীতির এই অমর শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে। পিতার নাম ইউসুফ আলী। শৈশবেই আলীম তার পিতাকে হারান। এ অবস্থায় তার মনের কোণে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই বিচ্ছেদই তাকে সঙ্গীতের দিকে টেনে নিয়েছিল। প্রায়ই গুন গুন করে তিনি গাইতেন, বৃদ্ধ পিতামহ (দাদা) অলক্ষ্যে তা দাঁড়িয়ে শুনে যেতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতেন তার চেয়েও বেশি। স্কুলে যখন ভালো লাগতো না তখন আলীম চলে আসতেন ভাগিরথী নদীর পাড়ে। ওখানে বসে নদীর দৃশ্য দেখে আর মাঝির কণ্ঠে গান শুনে ভাবতেন, কী করে রেকর্ডে গান করা যায়। কবেইবা কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীতে গান করবেন তিনি— এসব ভাবনা তাকে প্রায় সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। পাশের গ্রামে এক বাড়িতে ছিল কলের গান। প্রতিদিন ওই বাড়িতে গিয়ে কলের গানে কে. মল্লিক, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, রঞ্জিত রায়, অনিমা সেনগুপ্তা, পাহাড়ী সান্যাল, যুুথিকা রায়, তসের আলীসহ কত না শিল্পীর গান শুনে শুনে আবদুল আলীম নিজেও ওইভাবে গাইতে চেষ্টা করতেন। মা চাইতেন, ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু আলীম লেখাপড়া বাদ দিয়ে গান-বাজনায় মশগুল হয়ে পড়ল। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আবদুল আলীম নদীর পাড়ে বসে গান গাইতে গাইতে এক সময় মঞ্চে তার ডাক পড়ে। ১৯৪২ সালের কথা। মাত্র ১২ বছর বয়সে গুরু সৈয়দ গোলাম আলীর হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি । তার গ্রামের এক আত্মীয় তখনকার কলকাতার মেয়র। তাকে গান শোনালেন, গান শুনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাকে কলকাতায় রেখে দিলেন। এরপর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাকে নিয়ে যেতে লাগলেন গান গাওয়ানোর জন্য। এক সময় কলকাতার সব আসরে আলীমের উপস্থিতি আবশ্যিক হয়ে উঠল। এভাবে একদিন পরিচয় হয়ে গেল অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হকের সঙ্গে। তার স্নেহ লাভ করল আবদুল আলীম। তখন তো কলকাতার মঞ্চে গান গাইতেন তসের আলী, ওসমান খান, নুরুন্নাহার, নুরুদ্দিন, নায়েব আলী, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন প্রমুখ। তাদের পাশাপাশি যোগ হলেন এই আবদুল আলীম। মোহাম্মদ সুলতানের সহযোগিতায় কাজী নজরুল ইসলামের সুরে প্রথম রেকর্ডে তিনি গাইলেন ‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো সঙ্গে নিয়ে যাই’ এবং ‘আফতাব ওই বসলো পাটে আঁধার আইল শেষে’ গান দু’খানি। এর আগে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ‘উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়’ গানটি গেয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে শুনিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হলে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন ঢাকায়। এরপর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত পল্লীগীতি পরিবেশন করতে থাকেন। ১৯৫২ সালের বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনের লাহোর অধিবেশনে আলীমের যোগদান করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে পল্লীগীতি গেয়ে তিনি অকৃপণ প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ৫০টি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবদুল আলীম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখ ও মুখোশ, এদেশ তোমার আমার, জোয়ার এলো, সুতরাং, নদী ও নারী, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাত ভাই চম্পা, স্বর্ণকমল, গাঁয়ের বধূ, লালন ফকির, দস্যুরানী, উত্সর্গ, তীর ভাঙা ঢেউ। এসব ছবিতে শিল্পীর গাওয়া গান এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। আবদুল আলীম ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গীত প্রেমিকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তিনি চলে গেলেও তার গান এ প্রজন্মের শিল্পীরাও বিভিন্ন চ্যানেলে গেয়ে বাহবা পাচ্ছেন। অসংখ্য ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ইসলামী আর লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে আবদুল আলীম অমর হয়ে থাকবেন।

রাজকাপুরের নায়িকা নার্গিস

রাজকাপুরের ছবিতেই নার্গিস অভিনয় করে এখন পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে আছেন। বরসাত, শ্রী ৪২০, আওয়ারা, আন্দাজ, জাগতে রহো, আহ ছবিগুলোয় নার্গিসের নায়ক ছিলেন রাজ কাপুর। রাজ কাপুর-নার্গিস জুটির অনবদ্য অভিনয় দীপ্তির প্রসার ঘটেছিল আর কে ব্যানার থেকেই। নার্গিস নামে নানা কল্পিত কথা আর কে ফিল্মস থেকেই শুরু হয় এবং ওখানেই শেষ। তারপর কিংবদন্তি হয়ে রইলেন চিরকালের নায়িকা নার্গিস। নার্গিসের জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জুন কলকাতায়। তাঁর মা জড্ডন বাঈ একসময় প্রখ্যাত গায়িকা ছিলেন। আর নার্গিসের বাবার নাম ডা. উত্তম চাঁদ মোহন। জড্ডন বাঈকে বিয়ে করে ডা. উত্তম চাঁদ মোহন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। জড্ডন বাঈয়ের প্রথম দুই পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তারা হলেন আখতার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন। সবশেষে নার্গিসের জন্ম। জড্ডন বাঈ কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেন। এর মধ্যে ‘তালামি হক’ ছবিটি উল্লেখযোগ্য। এই ছবিতে নার্গিস বেবী রানী নামে শিশু শিল্পীর ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন। তখন নার্গিসের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। জড্ডন বাঈয়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক। এ জন্য নার্গিসকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়তি মানুষকে কোন পথে চালিত করে কেউ তা বলতে পারে না। ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করার ইচ্ছে তার পূরণ হলো না। শেষতক তিনি ছবির নায়িকা হয়ে গেলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মেহবুব খান পরিচালিত ‘তকদির’ ছবিতে নায়িকা হওয়ার পর নার্গিসের নাম প্রথম ছড়িয়ে পড়ল উপমহাদেশজুড়ে। ১৯৪৩ সালে ‘তকদির’ মুক্তি পায়। নার্গিসের নায়ক ছিলেন মতিলাল। এরপর ১৯৪৮ সালে মেহেবুব খানের ‘আগ’ ছবিতে রাজ কাপুরের বিপরীতে নার্গিস অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে নার্গিস তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম চরিত্রাভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন—১৯৪৮ সালে ‘মেলা’, ‘১৯৪৯ সালে আন্দাজ, বরসাত; ১৯৫০ সালে বাবুল, যোগান; ১৯৫১ সালে আওয়ারা, দিদার, হালচাল; ১৯৫২ সালে আনহোনি, ১৯৫৬ সালে ‘জাগতে রহে’, ১৯৫৭ সালে মাদার ইন্ডিয়া, পরদেশী প্রভৃতি ছবিতে। নার্গিস তার নিজের প্রতিষ্ঠান নার্গিস আর্ট প্রোডাকশন থেকে ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘আনজুমান’, ‘দারোগাজী’ এবং ‘ভীস্ম প্রতীজ্ঞা’ ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে নার্গিস মায়ের ও সুনীল দত্ত তার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের শেষ দিকে নার্গিস ভারতের রাজ্যসভার একজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে যান চিকিত্সার জন্য। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি মুম্বাই প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পর ১৯৮১ সালের ৩ মে মারা যান। নার্গিসের জীবনে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—আনবান (১৯৪৪), ইসমত্ (১৯৪৪), বিসম্বাদী (১৯৪৫), হুমায়ুন (১৯৪৫), রামায়নি (১৯৪৫), নার্গিস (১৯৪৬), আনজুমান (১৯৪৮), বিরহ কি রাত (১৯৫০), জান যাহবান (১৯৫০), খেল (১৯৫০), মীনা বাজার (১৯৫০), পিয়ার (১৯৫০), সাগর (১৯৫১), আম্বার (১৯৫২), রেওয়াফা (১৯৫২), সিসা (১৯৫২), আহ (১৯৫৩), ধুন (১৯৫৩), শাদী (১৯৫৩), পাপী (১৯৫৩), আঙ্গারে (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), চোরি চোরি (১৯৫৬), মিস ইন্ডিয়া (১৯৫৬), লাজওয়ান্তি (১৯৫৮) ও পিয়ার কি ওয়াতন (১৯৬৭)। ‘নার্গিস-রাজ কাপুর’ জুটিকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, এর নিরানব্বই ভাগই ছিল রটনা। নার্গিস-রাজ কাপুর জুটি থেকেই সিনেমা জগতে জুটি বাঁধার সূত্রপাত, যার ফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে দিলীপ-মধুবালা, দেব-সুরাইয়া, ধর্মেন্দ্র-হেমা, অমিতাভ-রেখা প্রভৃতি জুটি গড়ে উঠেছিল। রাজ কাপুর ছাড়া নার্গিসের নায়ক ছিলেন—দিলীপ কুমার, মতিলাল, অশোক কুমার, জয়রাজ, বলরাজ মাহানী, করন দেওয়ান প্রমুখ। বিয়ের পর নার্গিস অভিনয় ছেড়ে দিলেও স্বামী সুনীল দত্তের চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায় তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন নেপথ্যে থেকে। সুনীল দত্ত প্রযোজিত পরিচালিত মুঝে জিনে দো, ইয়াদিন, রেশমা আউর শেরা, মন কা মিত ইত্যাদি ছবিতে নার্গিসের অবদান উল্লেখ করার মতো। অভিনয় জীবন ছেড়ে দিলেও নার্গিস চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনি সমাজসেবায় নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন। মুম্বাইর বস্তিতে ঘুরে তিনি দরিদ্র অসহায় লোকজনের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তার প্রতিকারের চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে তিনিও অবদান রেখে গেছেন। নার্গিসের স্বামী সুনীল দত্ত আজ আর বেঁচে নেই। তার বড় ছেলে সঞ্জয় দত্ত ফিল্মে এক সময় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সঞ্জয়দত্তের বয়স এখন ৪৯ বছর। মেয়ে নম্রতার বয়স ৪৬ বছর ও প্রিয়ার বয়স ৪২ বছর। আজও কোথাও রাজ কাপুরের কথা উঠলে ‘নার্গিস’ নামটি সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে। তবে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন না বটে; কিন্তু তারা বিদেশে গিয়ে একত্রে কাটিয়েছেন—এমন খবরাখবর সেদিনের পত্রপত্রিকাগুলো এখনও প্রমাণ বহন করে যাচ্ছে।

স্মরণীয় পরিচালক জহির রায়হান

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- এই গানখানি প্রথম চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। সেদিনের চলচ্চিত্র দর্শকরা আজও ভোলেননি জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কথা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি বানিয়ে অমর হয়ে রইলেন জহির রায়হান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি নির্মাণের আগে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা ‘অমর ৮ই ফাল্গুন’ নামে ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেলেন না। যে জন্য প্রথম দিকে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ছবি করার সুযোগ পাননি তিনি। তবে এ জন্য জহির রায়হান পিছপা হননি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের চিত্র তুলে ধরার জন্য ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে ছবি না বানালেও বানিয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবিতে ঠিকই একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তুলে ধরলেন। ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ রিলিজের পরে বাঙালি দর্শকরা বুঝতে পারল, পশ্চিমাদের সঙ্গে আর নয়। দলে দলে লোকজন এ ছবি দেখার পরে সবার মুখেই ফিরতে লাগল—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। এ ছবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল’ গানখানিও ছিল। ছবিঘরে বসে এই গান শুনতেই সেদিন জনতার দেহের পশম দাঁড়িয়ে গেল। এদিকে রক্ত টগবগ করে উঠল। বাঙালিরা স্লোগান তুলল—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলা মাকে মুক্ত করো।’ জহির রায়হান শুরু থেকেই পরিচ্ছন্ন ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন। জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি ১৯৭০ সালে গুলিস্তানসহ ঢাকার ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। মুক্তির আগে ছবিটি সেন্সরে আটকে দেয়। পরে এটি তত্কালীন সরকার রিলিজ দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির তিন দিন পরে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্র আন্দোলন হওয়ার কারণে তত্কালীন সরকার ছবিটি প্রদর্শনের জন্য আবার অনুমতি দেয়। জহির রায়হান একাধারে সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক রাজনৈতিক কর্মী, প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। জন্ম তাঁর ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে। তাঁর আসল নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম ছিল ‘জাফর’। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের পরিবার ছিল তাদের। বড় ভাই বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)। জহির রায়হান ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। এক বছর পর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক, ‘প্রবাহ’-এর সম্পাদক এবং ‘এক্সপ্রেস’-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানী, সিনেমা, যুগের দাবি প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জহির রায়হান চলচ্চিত্রে প্রথম যোগ দিয়ে ছিলেন এজে কারদারের সহকারী হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৭) ছবিতে। ১৯৬০ সালে প্রথম পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ ছবিটির মাধ্যমে। জহির রায়হান পরিচালিত কাঁচের দেয়াল ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।‘কাঁচের দেয়াল’ পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির সম্মান অর্জন করেছিল। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—সংগম (১৯৬৫, এটি ছিল রঙিন ছবি), বাানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭) প্রভৃতি। তাঁর প্রযোজিত ছবি হলো-জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), মনের মতো বউ (১৯৬৯), শেষ পর্যন্ত (১৯৬৯) এবং প্রতিশোধ (১৯৭০)। প্রামাণ্য চিত্র হলো—স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), বার্থ অব এ নেশন (১৯৭১), লিবারেশন ফাইটার্স (১৯৭১) এবং ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স (১৯৭১)। তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো—শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), বরফ গলা নদী (১৯৬৯), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি কলকাতায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’ গঠন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে তিনি নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের স্ত্রী সুমিতা দেবী। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিটি নির্মাণের সময় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করন।

বাঙালির প্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেন

সেই কবে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’র বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে সুচিত্রা সেন ঝড় তুলেছিলেন বাঙালি হৃদয়ে। তারপর ৫৭ বছর কেটে গেছে। এদিকে তার বয়স এত দিনে আশির কোঠায় চলে এসেছে। তবুও সৌন্দর্য এবং সুচিত্রা সমার্থক হয়ে আছে বাঙালি দর্শকের চোখে। ‘অগ্নি পরীক্ষা’ ছবিতে অভিনয় করলেন ১৯৫৪ সালে। এ ছবিটি তাকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তো ‘পথে হলো দেরি’, ‘হারানো সুর’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’ ছবিগুলোর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই সুচিত্রা সেন। ১৯৭৮ সালে অভিনয় ছেড়ে দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত কোটি দর্শকের হার্টথ্রব। এপার বাংলা ওপার বাংলার জনগণমননন্দিতা চিত্র নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেনি। এখনও সুচিত্রা অনেকের হৃদয়ের রানী। কলকাতার বালিগঞ্জের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে তিনি বৃদ্ধা বয়সের দিনগুলো কাটাচ্ছেন এখন। তার দেখাশোনার জন্য রয়েছে কয়েকজন পরিচারিকা। চলাফেরা করতেও তার অসুবিধা হচ্ছে। তার ঘরে একমাত্র কন্যা মুন মুন সেন, নাতনিরাসহ নিকটাত্মীয়রা প্রবেশ করারই অনুমতি পাচ্ছেন। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতেও তিনি কখনও আগ্রহী ছিলেন না। গ্রেটা গার্বোর মতো তিনিও বরাবর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন। তার এ বয়সের দিনগুলো কাটছে পূজা-অর্চনা করে। কয়েক বছর আগেও তিনি ঘরে বসে টেলিভিশনে প্রদর্শিত তারই ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। এখন নাকি তার তাও ভালো লাগছে না। সুচিত্রা সেন তার জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে গেলেন। এই মহান নায়িকা সম্পর্কে জানা যায়, তার নায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা গেলে সেই রাতে এসেছিলেন একখানি মালা হাতে নিয়ে। মহা নায়িকা সুচিত্রা সেন মহানায়কের গলায় সেই মালা রেখে গিয়েছিলেন সেই রাতে। সুচিত্রা সেন ফিরে এলেন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, তারপর তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল বিহারের পাটনায়। জন্মের কয়েক বছর পর চলে এলেন পাবনাতে। শৈশবকাল কেটেছে পাবনা শহরে। সে সময় তার নাম ছিল রমা সেন। কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম বসন্তে তিনি অনেক নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাবনা ছেড়ে বাবার সঙ্গে চলে গেলেন কলকাতায়। ওই বছরই তার বিয়ে হয় আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথের সঙ্গে। শ্বশুরের যে সম্পত্তি ছিল তাতে স্বামী এবং তার ভালোভাবে দিন কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু দিবানাথ সেন এতই মদ খেতেন যে টাকা সংগ্রহের জন্য জায়গাজমি বিক্রি করে দেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে রমা সেনকে সিনেমায় নামতে হয়। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেন চলচ্চিত্র জগতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছবিটি মুক্তি পেল না। এরপর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে প্রতিষ্ঠা পেলেন। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন সমর রায়। সুচিত্রা সেন তার অভিনীত জীবনে মোট ৬০টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত একবার বলেছিলেন, “১৯৫১ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অসিত চৌধুরী আমাকে বললেন, একটি ভালো শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয় সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে খুব নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন ওর স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। দেখলাম, ছিপছিপে চেহারায় ডাগর ধরনের চোখ। চোখ দু’টি বড় সুন্দর আর খুব এক্সপ্রেসিভ, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উজ্জ্বলতায় ভরে যায়। এক নজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে একটু বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম।” ‘সাত নম্বর কয়েদি’র পরে পিনাকী মুখার্জির ‘সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও তিনি সুচিত্রা সেন নামে আসেননি। এর পরের ছবি অর্থাত্ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে তিনি রমা সেন পাল্টিয়ে সুচিত্রা সেন নামে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি ১৯৫২ সালে মুক্তি পায়। তখন বাংলা সিনেমায় দুঃসময় চলছিল। কানন দেবী, উমাশশী, সাধনা বসুর যুগ শেষ। ঠিক সেই সময় অনেকের চোখে তিনি ধরা পড়েন। তাছাড়া ওই সময় সুরাইয়া, নার্গিস, নিন্মি ও নাদিরার হিন্দি ছবি দেখার জন্য বাঙালি দর্শকের ভিড় উপচে পড়ত। সুচিত্রা সেনের আগমনে ভিড়টা ক্রমে চলে এলো বাংলা ছবির দিকে। সুচিত্রা সেন থাকলেই হলো। শুরু হলো সুচিত্রা সেনের অপ্রতিহত জয়যাত্রা। আরম্ভ হলো ভক্তদের কত উদ্ভট সব জল্পনা-কল্পনা। সুচিত্রা সেন কেমনভাবে দিন কাটান, কী খান, কীভাবে কথা বলেন ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা ও গবেষণা চলতে থাকে চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তায় কিংবা বাড়িতে, স্কুল-কলেজে। এমনিভাবে সুচিত্রাকে নিয়ে উদ্দাম কল্পনা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আনন্দের ব্যাপার এই যে এখন পর্যন্ত সেই কল্পনার সমাপ্তি ঘটেনি। ১৯৫৪ সালে তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে গেল। এ ছিল যেন বিস্ময়কর প্রতিভার এক স্বাক্ষর। ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘অন্ন পূর্ণার মন্দির’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অগ্রদূত’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘মরণের পরে’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’ প্রভৃতি ছিল ১৯৫৪ সালের ছবি। প্রতিটি ছবিই সে সময় ব্যবসাসফল হয়েছিল। উল্লিখিত ছবিগুলোয় সুচিত্রা সেনের নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। পরবর্তী সময়ে এই জুটি ঝড় তুললো সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), ত্রি ঘামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৬), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), সূর্যতোরণ (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাসা (১৯৬২), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির উত্তম কুমার মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। সুচিত্রা সেনও ফিল্ম লাইন ছেড়ে দিয়েছেন ৩৫ বছর আগে। তবুও এই জুটির পুরনো ছবিগুলো এখনও সমান জনপ্রিয়। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা সেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’, ‘প্রণয় পাশা’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘হসপিটাল’ সুচিত্রার জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন অশোক কুমার। এ ছাড়া অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে স্মৃতি টুকু থাক, বসন্ত চৌধুরীর বিপরীতে ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ ছবির কথাও যে ভোলার নয়। সুচিত্রা সেন হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। যেমন—মুসাফির, দেবদাস, বোম্বাইকা বাবু থেকে মমতা পর্যন্ত প্রায় ছয়-সাতখানা ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। হিন্দি ‘দেবদাস’-এ তিনি পার্বতীর ভূমিকায় ছিলেন আর দেবদাস সেজেছিলেন দিলীপ কুমার। ১৯৭০ সালের ২৯ নভেম্বর স্বামী দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পর সুচিত্রা সেন অসহায় হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ছবিতে আর অভিনয় নয়। নিকটতম ঘনিষ্ঠ কয়েকজন চিত্র পরিচালকের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি বলেই পরে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে ১৯৭৮ সালে ছবির জগত থেকে চিরতরে বিদায় নেন। শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন অনেক আগেই অতীতের গৌরবময় দিনগুলো হারিয়ে ১৯৮০ সালের পর থেকে একাকী জীবন কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন। আর এ জন্যই তিনি এরপর থেকে কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাত্কার দেননি। কাউকে ছবিও তোলার অনুমতি দেননি। এর কারণ এও হতে পারে যে নানা রংয়ের রঙিন দিনগুলো যে আর ফিরে পাবেন না। এটা কী কম কষ্টের ব্যাপার—এই অনুশোচনায় তিনি নীরব হয়ে গেলেন। আসলে গ্ল্যামার জগতেরই এ নিয়ম। পাবনা শহরে তার বাড়িটি যে ভাবে নীরব-নিস্তব্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক রূপকথার নায়িকা সুচিত্রা সেন ক্লান্ত হয়ে অবশেষে অনুরূপভাবে দাঁড়িয়ে আছেন-থমকে আছেন। তাকে নিকটাত্মীয়রা ছাড়া কেউই যে দেখতে পান না। আর এ জন্যই কোটি দর্শকের ইচ্ছে, সুচিত্রা সেনকে আরেকবার যে দেখতে চাই। কিন্তু সে ইচ্ছে যে আর পূরণ হওয়ার নয়। ইচ্ছেটা স্বপ্ন হয়েই থাকবে। কারণ সুচিত্রা সেন যে রহস্যময়ী। আর এ জন্যই তো তিনি কিংবদন্তি।

হলিউডের তারকা সোফিয়া লরেন

সোফিয়া অভিনেত্রী হয়েছিলেন, পাশাপাশি তাকে হতে হয়েছিল সেক্স সিম্বলও। তাই বোধহয় সার্থক অভিনেত্রীর পাশাপাশি প্লে গার্লের ইমেজও তাকে বয়ে বেড়াতে হয় এখনও। সোফিয়া লরেনের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমের এক অখ্যাত পরিবারে। তার কৈশোর জীবন কেটেছিল নেপলস শহরের উপকণ্ঠে নানার বাড়িতে। ছোটবেলায় তার চেহারা খুব সুন্দর ছিল না। একেবারে বিশ্রী অর্থাত্ কুিসত। তার ওপর হাত-পাগুলো ছিল ভীষণ লম্বা। অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থেকে তার অবস্থা এমনি হয়েছিল। ১২ বছর বয়স পূর্ণ হতেই তার সারা শরীরে আসে সৌন্দর্যের জোয়ার। এর পেছনে কাজ করেছিল প্রতিদিন শরীরের প্রতি যত্ন নেয়া। শরীর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অল্প বয়স থেকেই তিনি নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করেছিলেন। সোফিয়া লরেন ইতালিতে এবং হলিউডে দু’জায়গাতেই ছবি করেছেন। ১৯৫১ সাল থেকে সিনেমায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। এ পর্যন্ত তার ছবির সংখ্যা ষাটের বেশি হবে না। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—ও ম্যান অব দ্য রিভার, ‘দ্য কি’, ‘দ্যাট কাইন্ড অব ওম্যান’, ‘হেলার ইন পিংক টাইটস’, ‘টু উইমেন’, ‘বোক্কাচ্চিয়ো ৭০’, ‘ইয়েস্টারডে’, ‘টুডে’, ‘টুমরো’, ‘ম্যারেজ ইটালিয়ান স্টাইল’, ‘সান ফ্লাওয়ার’, ‘আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’, ‘আঞ্জেলা’, ‘রানিং অ্যাওয়ে’ প্রভৃতি। সোফিয়া লরেন ১৯৯১ সালে সম্মানসূচক অস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উত্সবে তার সামগ্রিক চলচ্চিত্র কর্মের জন্য তাকে সম্মানিত করা হয়। অভিনেতা ক্যারি গ্রান্টের সঙ্গে এক সময় প্রেম করেছেন। তবে বিয়ে করেছেন প্রযোজক কার্লো পন্টিকে। সেই সোফিয়া লরেন ছবি করা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। ১৯৪৬ সালে রোমে চিত্রায়িত ‘কুদ ভাদিস’ নামে একটি ছবিতে সোফিয়া প্রথম অভিনয় করেছিলেন। অনেক কষ্টে এ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘কুদ ভাদিস’-এ সোফিয়া এবং তার মা দু’জনে অভিনয় করে ছিয়াত্তর ডলার পেয়েছিলেন। সোফিয়ার জন্মের আগে তার মা রোমিলডা একজন পুরুষকে ভালোবাসতেন। সেই প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের ফলেই রোমিলডা গর্ভবতী হন। লোকটি তাকে বিয়ে করতে আপত্তি জানায়। তার সন্তান যে ওই নারীর পেটে তা তিনি স্বীকার করলেন না। রোমিলডার গর্ভে জন্ম নিল এক সন্তান। ওই সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। দশের চোখে ছিল অবৈধ। সেই শিশুকন্যাই একদিন বড় হয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী হলেন। আর তিনিই তো সোফিয়া লরেন। সোফিয়ার মায়ের জীবন নিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়। ছবির গল্পের প্রধান চরিত্র ছিল সোফিয়ার মা রোমিলডা। ‘রোমিলডা’ নামের এই ছবিতে সোফিয়া মা ও মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। এই ছবি করা নিয়ে মায়ের সঙ্গে সোফিয়ার একটু মন কষাকষি ঘটেছিল। সোফিয়া লরেন প্রথমদিকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেন। উনিশ বছর বয়সে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘টম্পি নক্সি’ ছবিতে। তারপর রোমে আরও কয়েকটি ছবি করার পর ১৯৫৬ সালে তার ডাক এলো আমেরিকার হলিউড থেকে। হলিউডের ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি প্রযোজক কার্লো পন্টির কাছ থেকে বেশ সহযোগিতা পেলেন। কার্লো পন্টি তার নিজের ছবি ‘আফ্রিকা আন্ডারশিট’-এ সর্বপ্রথম নায়িকা হিসেবে সোফিয়াকে নিলেন। এরপর একে একে আট কি দশটি ছবিতে অভিনয় করলেন। ‘ও ম্যান অব দ্য রিভার’ ছবি নির্মাণকালে এ ছবির প্রযোজক-পরিচালক কার্লো পন্টির প্রেমে পড়লেন সোফিয়া লরেন। ১৯৫৭ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কার্লো পন্টি এর আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। সে ঘরে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল। ‘ও ম্যান অব দ্য রিভার’ ছবির মাধ্যমেই সোফিয়া লরেন ১৯৫৫ সালে ইতালির সেরা অভিনেত্রীর সম্মান লাভ করেছিলেন। ‘আফ্রিকা আন্ডার দ্য সি’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছিলেন। রাণী এলিজাবেথ এ ছবিটি দেখে এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ইতালির রোম ছেড়ে আমেরিকার হলিউডে যাওয়ার পর একেকটি ছবিতে অভিনয় করে তিনি ৮ লাখ ডলার করে পেতেন। পরে পারিশ্রমিক আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভালো অভিনয় করা সত্ত্বেও চিত্র সমালোচকরা সোফিয়াকে দেহসর্বস্ব অভিনেত্রী বলেই গণ্য করতেন। তাদের মতে, সোফিয়ার স্বাস্থ্য সমুজ্জ্বল দেহই হলো তার জনপ্রিয়তার কারণ। কিন্তু ‘ডিপায়ার আন্ডার দ্য এলমস’ এবং ‘টু ও ম্যান’ ছবি দুটি মুক্তি পাওয়ার পর চিত্র সমালোচকদের মত পালটে গেল। ‘ক্যাসন্ডা ক্রেসিং’ এবং ‘সান ফ্লাওয়ার’ ছবি দুটির মাধ্যমে সোফিয়া লরেন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেলেন। সোফিয়া লরেন একটা সময় মনে করতেন, মহিলাদের আকর্ষণ বাড়ায় নারীত্ব আর যৌন আবেদন। সোফিয়া লরেন এক সময় হলিউডে অ্যাপার্টমেন্ট করে সেটেল্ড হয়ে যান। কিন্তু নিজ দেশ ইতালির কথা ভুলতে পারেননি বলে রোম শহরে একটা বাড়িও করেছিলেন। প্রতি বছর এক মাসের জন্য এসে সেই বাড়িতে থেকে গেছেন। এতটা সুন্দরী না হয়েও সোফিয়া লরেন চলচ্চিত্রে যোগ দিয়ে ঝড় তুলেছিলেন। মডেল গার্ল হিসেবেও তিনি বেশ এগিয়েছিলেন। তার অভিনীত ‘টু ও ম্যান’ এবং ‘সান ফ্লাওয়ার’ ছবি দুটি এক সময় ঢাকার অভিজাত প্রেক্ষাগৃহগুলোয় রিলিজ হয়েছিল। তখন এ ছবি দুটি দেখার জন্য দর্শকের প্রচণ্ড ভিড় জমেছিল প্রেক্ষাগৃহের সামনে। সে কথা কী ভোলার! তিনি হলিউডের ছবিতে অভিনয় করে রীতিমত হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তির তারকা। তার ঐশ্বর্য-খ্যাতি এখনও যে ভোলার নয়।

এপ্রিল ১৭, ২০১১

ঢাকার প্রথম নায়িকা : পূর্ণিমা সেনগুপ্তা

প্রায় ৫৫ বছর আগে ঢাকায় ফিল্ম নির্মাণ শুরু হয় ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি দিয়ে। এই ছবিতে তিনজন নায়িকা ছিলেন, এরা হলেন নাজমা (পিয়ারি বেগম), জহরত আরা আর পূর্ণিমা সেন গুপ্তা। ছবির পরিচালক আবদুল জব্বার খান ছিলেন ছবির নায়ক। তারই নায়িকা ছিলেন পূর্ণিমা সেন গুপ্তা। এখনকার নায়িকাদের পথিকৃত্ তো তিনিই। সেই পূর্ণিমা সেন গুপ্তার কথা ক’জনই বা মনে রেখেছেন! তবে ঢাকার ফিল্মের কথা উঠতেই পূর্ণিমা সেন গুপ্তার নামটি উঠে আসবে। পূর্ণিমা সেন গুপ্তা মারা যান ১৯৯৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর ১৩ বছর পেরিয়ে গেল। সেদিনের দর্শকরা এখনও তার কথা মনে করেন। মনে করবেনই না কেন, তিনি যখন ফিল্মে এসেছিলেন তখন সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে ছায়াছবির তারকাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। আজ এমনটি কোথায়? আর সেদিন (১৯৫৬ সালে) ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি রিলিজের আগে ও পরে পূর্ণিমা সেন গুপ্তাকে নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তিনি যখন ফিল্মে আসেন তখন ঢাকায় ফিল্ম নির্মাণ সবেমাত্র শুরু। প্রথমদিকে কোনো বছর ছবি নির্মিত হয়েছে, আবার কোনো বছর হয়নি। যে জন্য পরবর্তী সময়ে আর কোনো ছবিতে তার নায়িকা হওয়া সম্ভব হয়নি। পূর্ণিমা সেন গুপ্তার জন্ম ১৯৩০ সালে আসামের (অসম) গৌহাটি শহরে। শৈশবের কিছুদিন তার সেখানেই কেটেছিল। পরে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় তার পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। চট্টগ্রামে এসেই বাবা-মায়ের উত্সাহে তিনি নাচগান শেখা শুরু করেন। বয়স তখন ছয় ছিল হয়তো বা। চট্টগ্রামে কোনো ফাংশন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ণিমা সেখানে প্রায় সময়ই অংশ নিতেন। প্রথমদিকে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে খুব নাম করেন। বড়-বড় সওদাগর পূর্ণিমার নাচ দেখার জন্য রাতের পর রাত বিনিদ্র রজনী কাটাতেন তখন। সবারই অপেক্ষা ছিল কখন পূর্ণিমা স্টেজে আসবেন আর কখনই বা নাচ শুরু করবেন। নাচের পাশাপাশি এক সময় তিনি মঞ্চে অভিনয়ও শুরু করেন। ১৯৪৪ সালের কথা। ওই বছর থেকেই তিনি মঞ্চে নায়িকা হিসেবে অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। সেই সময় তিনি মলিনা দেবী, রানীবালা, উমাশশী, প্রমিলা ত্রিবেদী, সাধনা বসু, লীলা দেশাই প্রমুখ অভিনেত্রীদের ছবি দেখে দেখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, কী করে ফিল্মের নায়িকা হওয়া যায়। কলকাতা বহু দূরে, তাই ওখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় অবস্থান করেই মঞ্চে একের পর এক নাটকে অভিনয় করে গেলেন। সে সময় তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, নন্দলাল, গুনাইবিবি, বেদের মেয়ে, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাধাকৃষ্ণ, আলোমতি, ভেলুয়া সুন্দরী, কমলার বনবাস, মহুয়া, চাঁদ সওদাগর, গরিবের মেয়ে, চণ্ডীদাস প্রভৃতি। থিয়েটারের এসব নাটকে পূর্ণিমাই ছিলেন নায়িকা। ১৯৫৪ সালের কথা। ইত্তেহাদ পত্রিকায় ছাপা হলো ‘খান জামান শিগগিরই ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নায়িকার জন্য কয়েকটি মুখ চাই।’ বিজ্ঞাপন পড়ে পূর্ণিমা মনে মনে ভাবলেন, ‘এবার ফিল্মের নায়িকা হতে পারব...।’ সঙ্গে সঙ্গে খামের ভেতর ছবি ও চিঠি ভরে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় আবদুল জব্বার খানের ঠিকানায়। ছবিটা দেখে আবদুল জব্বার খান পূর্ণিমা সেন গুপ্তাকে পছন্দ করলেন। তত্ক্ষণাত্ চিঠি লিখে দিলেন দেখা করার জন্য। একদিন পূর্ণিমা সেন এসে উপস্থিত হলেন আবদুল জব্বার খানের সামনে। উপস্থিত সবাই পূর্ণিমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। এভাবেই পূর্ণিমা সেন ঢাকার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’র নায়িকা হয়ে গেলেন। প্রথম ছবির নাম রাখা হয়েছিল ‘ডাকাত’। পরে নাম পাল্টে ‘মুখ ও মুখোশ’ করা হলো। নায়িকা হিসেবে পূর্ণিমা সেনের প্রথম ও শেষ ছবি ছিল এই ‘মুখ ও মুখোশ’। এর পরে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে ‘হাম সফর’ আর ‘সোনার কাজল’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৬২ সালে। পূর্ণিমার জীবন কাহিনী চমকপ্রদ। ১৯৬২ সালে তিনি চিত্র প্রযোজক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নাছিরকে বিয়ে করে চিত্রজগত থেকে দূরে সরে যান। নাছিরকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পূর্ণিমা সেন গুপ্তা থেকে হলেন পারভীন বানু। ১৯৭১ সালে বড় ছেলে বাবলা মারা যাওয়ায় অনেকটা ভেঙে পড়লেন। স্বামী নাছির তাকে ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ায় সংসারের পুরো দায়িত্ব পূর্ণিমার ওপর পড়েছিল। নিজের চেষ্টায় ছেলেমেয়েদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন। তারই মেয়ে নাসরিন এক সময় ফিল্মের নায়িকা হয়েছিলেন। শেষ জীবনটা তার কেটেছিল নাসরিনের বাসায়। একদা এ দেশে অভিনয় করার জন্য মহিলা খুঁজে পাওয়া যেত না, ঠিক তখন পুরুষরাই মহিলা সেজে নারী চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলত। সেই সন্ধিক্ষণে এক অর্থে বিদ্রোহ করেই পূর্ণিমা সেনগুপ্তা মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। অন্যদিকে ঢাকার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ নায়িকা হিসেবে অভিনয় করে এক কিংবদন্তি সৃষ্টি করলেন ১৯৫৬ সালে। যে জন্য ঢাকার ফিল্মে নায়িকাদের পথিকৃত্ হয়ে থাকবেন এই পূর্ণিমা সেন গুপ্তা।

এপ্রিল ১৪, ২০১১

হলিউডের প্রথম মহাতারকা গ্রেটা গার্বো

গ্রেটা গার্বোকে বলা হতো বিউটি অব দ্য বিউটি হলিউডের প্রথম দিকের জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনিই গ্রেটা হঠাত্ করেই ১৯৪১ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকালে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়ে জনজীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তার অভিনীত শেষ ছবি ছিল ‘টু ফেসড ওম্যান’ বিখ্যাত এই নায়িকা ১৯৯০ সালের ১৫ এপ্রিল নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে পরলোকগমন করেছিলেন তারপর ২১টি বছর পার হলো তবু কি চলচ্চিত্র দর্শকরা তার কথা ভোলতে পেরেছেন! ভোলতে না পারারই কথা আমেরিকায় মাঝেমধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তার ছবি দেখানো হলে অনেকেই তা আগ্রহ নিয়ে দেখেন আজ যারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তারাও গ্রেটার প্রশংসা করেন নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সারা দুনিয়ার সিনেমা দর্শকদের স্বপ্নের দেবী ছিলেন এই গ্রেটা গার্বো তার জন্ম ১৯০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউরোপ মহাদেশের সুইডেনের স্টকহোমে তিনি ১৪ বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করেন এরপর তিনি ক্ষৌরকার দোকান ছাড়াও টুপি, চুলের ফিতা ইত্যাদি বিক্রির দোকানে কিছুদিন কাজ করেন হঠাত্ করেই একদিন সুইডিস ছবির পরিচালক এরিখ ফেসলারের চোখে ধরা পড়লেন গ্রেটা পরিচালক এই মেয়েটিকে পর্যন্দ করলেন এই পরিচালকের কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি তার শৈশব জীবন কেটেছিল সুইডেনের স্টকহোমে বয়স যখন ১৭, তখন চিত্র পরিচালক মরিস স্টিলার তাকে হলিউডে নিয়ে যান গ্রেটা অপূর্ব সুন্দরী ১০০ বছরে এমন একজন সুন্দরী মেলে একদিন এ মেয়েটি পৃথিবীর সেরা অভিনেত্রী হবেই...” ঠিকই গ্রেটা গার্বো একদিন পৃথিবীর সেরা অভিনেত্রী হয়েছিলেন ১৯২৬ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ছিল তার অনুকূলে এ সময়ে তার অভিনীত ছবিগুলো হলো দি টরেন্টো (১৯২৬), ফ্লেশ এট দি ডেভিল (১৯২৭), দি ডেভিন ও ম্যান (১৯২৮), অ্যানা ক্রিশটাই (১৯৩০), রোমান্স (১৯৩০), মাতাহারি (১৯৩১), গ্র্যান্ড হোটেল (১৯৩২), কুইন কৃষ্টিন (১৯৩৩), দি রেইনটেড ডেইলি (১৯৩৪), অ্যানা কারেনইনা (১৯৩৫), ক্যামিলি (১৯৩৭), কনকোয়েস্ট (১৯৩৭), নোনোভস্কায় (১৯৩৯) প্রভৃতি ১৯২৭ সালে ‘ফ্লেশ অ্যান্ড ডেভিল’ ছবিতে গ্রেটা গার্বো জন গিলবার্টের সঙ্গে জুটি বেঁধে সারা বিশ্বের তরুণ দর্শকদের বুকে ঝড় তুলেছিলেন এ ছবির ‘লিও আর ফেলিসিটা’ দান্তে বিয়েত্রিচ, রোমিও জুলিয়েট, অ্যান্তনি ক্লিওপেট্রার মতো স্মরণীয় হয়ে থাকল এ ছবিতে অভিনয়কালে গ্রেটা গার্বো আর জন গিলবার্ট একে অপরের প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন গিলবার্ট গ্রেটার নিঃসঙ্গ জীবনে প্রেমের জোয়ার আনলেন অনেক দিন রাতে গিলবার্টের টাওয়ার রোডের বাড়িতে গ্রেটা অতিথি হয়েছিলেন কিন্তু হঠাত্ করেই ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গেল গ্রেটার জীবনে আরো কয়েকজন পুরুষ এসেছিলেন, এদের মধ্যে মরিস স্টিলার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রেটাকে তিল তিল করে তৈরি করেছিলেন স্টিলার তিনিই গ্রেটাকে হলিউডে নিয়ে এসেছিলেন স্টিলার যখন শুনলেন, গ্রেটা গিলবার্টের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছেন, তখন তিনি লসএনঞ্জেলেস ছেড়ে সুইডেনের স্টকহোমে চলে যান কিছুদিন পরই এই স্টিলার এক হাসপাতালে মারা যান সম্ভবত এ কারণেই গ্রেটা গার্বো নীরবে বিদায় নিয়ে সঙ্গী করলেন নির্জনতাকে রিচার্ড শীল্ড, লিও কেন্ডি স্টোকে স্কি, সিসিন বীটনসহ অনেক খ্যাতনামা লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার কিন্তু জীবনে কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারেননি বার বার প্রেমে জড়িয়েও গ্রেটা বিয়েতে রাজি হননি এ প্রসঙ্গে তিনি বরাবর একটা কথাই বলেছেন, ‘নিঃসঙ্গ জীবন যত কষ্টকর হোক না কেন, আমার কাছে তা অত্যন্ত মধুময়’ গ্রেটা গার্বো গোটা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য স্থান ঘুরে দেখেছিলেন সেই যৌবনে আর বার্ধক্যে কখনও তিনি স্থায়ীভাবে কোনো আবাসস্থল গড়েননি কখনও সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড কখনও আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন শহরে কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেছেন সারা বছর তিনি হোটেলে কিংবা ভাড়া করা বাড়িতে থেকেছেন মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগেও তিনি সকালে নাস্তা খাওয়ার আগে একটানা প্রায় এক ঘণ্টা ব্যায়াম ও জগিং করতেন আর নিয়মিত দিনে কয়েক মাইল পথ হাঁটতেন শেষ জীবনে তিনি বহুবার বলেছেন : ‘অবচেতনভাবে আমি সর্বদা সুখের সন্ধান করেছি, কিন্তু সুখ কোথাও পাইনি সুখী জীবন অন্তত আমার জন্যে নয়’ হলিউডে তার ষোল বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ১১ বার আবাসস্থল বদল করেছিলেন হলিউড ছেড়ে যাওয়ার পর গ্রেটা চলে গেলেন সুইডেনে সেখানে সাত কামরার এক অ্যাপার্টমেন্টে বহুদিন বসবাস করেছিলেন তখন কদাচিত্ ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখতেন চলচ্চিত্র লাইব্রেরিতে কিংবা পুরনো বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতেন গ্রীষ্মে চলে যেতেন সুইজারল্যান্ডের ক্লোসটার্সে নিজ বাড়িতে এ ভাবেই কেটে গেছে দশকের পর দশক; কিন্তু কখনই কোনো সাক্ষাত্কার দেননি কোনো সাংবাদিককে পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকরা যা লিখেছিলেন তা বানিয়েই লিখতেন গ্রেটা তা পড়ে নীরবে হাসতেন গ্রেটার আসল নাম ছিল গ্রেটা লভিসা গুস্টাফসন একই সময় গ্রেটা কয়েকটি বিজ্ঞাপনে মডেল হন এমজিএম চিত্র প্রতিষ্ঠানের ‘দি টরেন্টো’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করলেন হলিউডের পত্রপত্রিকায় লেখা হলো : ‘রুপালি পর্দার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দেবীদের অন্যতম নবাগতা গ্রেটা গার্বো অপূর্ব অভিনয় করেছেন