পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২২, ২০১১

ফার্স্ট লেডি সুমিতা দেবী

ঢাকার ছবির প্রথম দিককার নায়িকা হলেন সুমিতা দেবী। সুমিতা দেবী অভিনীত ‘আকাশ আর মাটি’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই। এই ছবিটি তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে প্রথম। তবে তিনি ‘আসিয়া’ ছবিতে প্রথম কাজ শুরু করেন। ‘আসিয়া’য় তার নায়ক ছিলেন শহীদ। ১২টির মতো ছবিতে সুমিতা নায়িকা ছিলেন। তাকে বলা হয় ঢাকার ফিল্মের প্রথম ফার্স্ট লেডি। ফিল্মে যোগ দিয়ে তার নাম হয়েছিল সুমিতা দেবী। আসল নাম তার ‘হেনা’। ১৯৩৫ সালে ঢাকার মানিকগঞ্জে তার জন্ম। ১৯৪৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে হেনা ঢাকায় চলে এলেন। এসেই বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে হেনা পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে কিছুদিন ছিলেন, এরপর কলকাতায় ফিরে আসতেই হেনার বিয়ে হয়ে গেল অতুল লাহিড়ির সঙ্গে। হেনা থেকে হয়ে গেলেন হেনা লাহিড়ি। ওদের এ বিয়ে বেশিদিন টিকল না। ১৯৫৭ সালে হেনা ফিরে এলেন ঢাকায়। এদিকে ঢাকায় ছবি নির্মাণ হচ্ছে শুনে হেনার ইচ্ছে জাগল তিনিও ফিল্মে অভিনয় করবেন। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে এ ছবিতে তার অভিনয় করা সম্ভব হয়নি। পরে ওই চরিত্রটি করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে তৃপ্তি মিত্র। ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ ছবিতে হেনা নাম পাল্টিয়ে ‘সুমিতা দেবী’ নামে প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন তিনি। তবে ‘আসিয়া’ রিলিজের আগেই নায়িকা সুমিতা দেবীর ‘আকাশ আর মাটি’ এবং ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে তার দুই নায়ক ছিলেন। তারা হলেন—আমিন ও প্রবীর কুমার। ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে সুমিতার বিপরীতে ছিলেন আনিস। এ ছবি দুটিতে সুমিতা ও আনিস বিভিন্ন রোমান্টিক দৃশ্যে অংশ ছাড়াও কয়েকটি গানের দৃশ্যে ছিলেন। মাহাবুবা রহমানের গাওয়া সুমিতা দেবীর লিফে—‘নয়নে লাগলো যে রঙ আহা তা কেউ জানলো না’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতেই ছিল এই গানটি। ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়। নায়ক ছিলেন শহীদ। আসিয়া ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের গাওয়া—‘মেঘে দেওয়ায় করছে মেঘলী তোলাইল পূবাল বাও’ গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। ছবিতে তার প্রেমিক শহীদ। কিন্তু ছবির কাহিনী অনুযায়ী শহীদের চাচা কাজী খালেকের সঙ্গে সুমিতার বিয়ে হয়। প্রেমিকা সুমিতা হয়ে গেলেন প্রেমিক শহীদের চাচী। এটা দুজনে মেনে নিতে পারেননি। যে জন্য শেষতক ওদের সহমরণ হয়েছিল। নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবীর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আরও রয়েছে—সোনার কাজল (১৯৬২, নায়ক খলিল), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩, নায়ক আনোয়ার হোসেন), এই তো জীবন (১৯৬৪, নায়ক রহমান), দুই দিগন্ত (১৯৬৪, নায়ক আনোয়ার হোসেন), ধূপ ছাঁও (১৯৬৪, নায়ক এজাজ), জনম জনম কি পিয়াসি (১৯৬৮), সঙ্গম (১৯৬৩, নায়ক খলিল), অশান্ত প্রেম (১৯৬৮, নায়ক হায়দার শফী)। এ দেশ তোমার আমার ছবি সম্পর্কে সুমিতা দেবী তার জীবদ্দশায় জানিয়েছিলেন, এ ছবির সবচেয়ে সার্থক অংশ হলো সঙ্গীত। আমার সহশিল্পী দাগু বর্ধন জমিদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি প্রতিটি দৃশ্যে আশ্চর্য অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। নায়ক আনিস বিশেষ করে তার দীপ্ত মুখখানা এখনও আমার চোখে ভাসে। অভিনয় গুণে তিনি নায়ক চরিত্র সার্থক করেছিলেন। সুভাষ দত্ত, রহমান, মেসবাহ প্রমুখ অভিনেতাও ‘এ দেশ তোমার আমার ছবিতে ছিলেন। রহমান ছিলেন খলনায়ক। বাঙালি মেয়ে সুমিতা দেবী এক সময় ঢাকা থেকে লাহোরে গেলেন উর্দু ছবিতে অভিনয় করার জন্য। অবশ্য তার আগে সাতক্ষীরার মেয়ে স্মৃতি রেখা বিশ্বাস লাহোরের ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। লাহোরে গিয়ে সুমিতা ‘ধূপছাঁও’ ছবিতে অভিনয় করেন। ওই ছবিতে তার নায়ক ছিলেন নায়িকা-গায়িকা নূরজাহানের স্বামী এজাজ। ‘ধূপছাঁও’ ছবিটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে সুমিতা দেবী নায়িকা চরিত্র ছেড়ে দিয়ে মা, খালা, ভাবীর চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৯ সালের শেষদিকে ‘কখনো আসেনি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে তারা একে অপরকে মন দিয়ে বসলেন। তারপর দু’জনে গোপনে কোর্টে গিয়ে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তারা প্রায় ৮ বছর ধরে সুখের সংসার করেন। এরপর তার স্বামী জহির রায়হান আবারও বিয়ে করার কারণে সুমিতা দেবীর জীবনে দুঃখ নেমে আসে। সুমিতা দেবী কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মায়ার সংসার, আদর্শ ছাপাখানা, নতুন প্রভাত, আগুন নিয়ে খেলা, মোমের আলো প্রভৃতি। ১৯৭১ সালে কলকাতায় থাকাকালীন সুমিতা দেবী উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘শ্রী শ্রী সত্য শাহী বাবা’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন। ৮০ ভাগ শুটিং শেষে ছবির কাজ আর হলো না। সুমিতা দেবী মারা যান ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি। ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘আকাশ আর মাটি’, ‘এই তো জীবন’ প্রভৃতি ছবিতে স্মরণীয় অভিনয় করে সুমিতা দেবীও কিংবদডিন্ত হয়ে রইলেন।