পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২১, ২০১১

নজরুল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

নানা রকম বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন সঙ্গীত সাধনা করে ফিরোজা বেগম শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয় হয়েছেন। আশির কোঠায় এখন তার বয়স। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরু থেকে তিনি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর প্রায় সাত দশক পার হলো। এখন তিনি অসুস্থ। এরই মধ্যে তার চিকিত্সার পেছনে কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। অথচ মস্তবড় এই শিল্পীর চিকিত্সার ব্যাপারে কোনো সংগঠন বা সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। এটা দুঃখজনক। এটা ফিরোজা ভক্তদের মনে দারুণ কষ্ট দিয়েছে। ফিরোজা বেগম মানেই বাংলার গৌরব। তিনি জীবদ্দশায় হয়েছেন কিংবদন্তি। তার মতো মস্তবড় শিল্পী আমাদের দেশে আর কোথায়? তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি আজীবন সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। অসুখ অবস্থায়ও তিনি সঙ্গীত নিয়ে ভাবেন। এ রকম কি আর কেউ ভাবেন? চিত্ত রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, কমল দাস গুপ্ত, সুধীর লাল চক্রবর্তী ছাড়া আরও অনেকে তার কাছে এখনও স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি। ‘বউ কথা কও, কও কথা অভিমানিনী’—গানের এ কথা মনে হলে ফিরোজা বেগমের নামটি হৃদয়ে বার বার জেগে ওঠে যে কোনো সঙ্গীতপ্রেমিকের হৃদয়ে। উঠবেই না কেন, তিনি যত গান গেয়েছেন তার সবই তো শ্রোতাদের মনে দাগ কেটে আছে। সে জন্য ফিরোজা বেগমের গাওয়া গানগুলো বার বার শুনেও লাখো শ্রোতার মনের পিপাসা যে মিটছে না। ১৯৪২ সাল থেকে ফিরোজা বেগমের গান গাওয়া শুরু। দীর্ঘ সময়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। একটা সময়ে এসে তিনি নজরুলের গানই বেশি গাইতে লাগলেন। গান গাইতে গিয়ে তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন। যে জন্য তিনি কত শত পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ফিরোজা বেগম নজরুলের গান করেন—এ কথাই শ্রোতারা বলেন বেশি। তিনি অডিও ক্যাসেট ও সিডিতে রবীন্দ্রনাথের গানও করেছেন। তিনি গেয়েছেন অতুল প্রসাদ ও রজনী কান্তের গানও। ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯২৮ সালে ফরিদপুরে। একটু বড় হয়ে গান গাওয়ার ব্যাপারে তার পিতার গান শোনার শখ এবং মাতার গলার সুর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। ফিরোজা যখন ছিলেন কিশোরী, তখন তার কণ্ঠে গান শুনে সঙ্গীত ভুবনের গুণীজনরা বলতেন—এই মেয়ের গলায় রেকর্ড হতে পারে, এ কথা শুনে তিনি চমকাতেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি রেকর্ডে ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কৃষক চন্দ্র দে’র গান শুনতেন তন্ময় হয়ে। কিশোরী বয়সে ফিরোজা বেগমের প্রতিভা শুধু গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাঁতার, খেলাধুলা, ক্লাসিক্যাল নাচ ও গানের ক্ষেত্রে অসাধারণ বিশেষত্বে বিকশিত হয়ে ওঠেন। নাচ ও গানের জন্য স্বয়ং গুরু সদর দত্ত নিজ হাতে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। একবার কিশোরী ফিরোজা বেগম শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে ৬টি গান পরিবেশন করে ফরিদপুর শহরে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেন। সে তো ১৯৩৭ সালের কথা...। ফিরোজা বেগম মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাত্ ১৯৩৯ সালে চলে গেলেন কলকাতায়। তার বড় বোন তখন কলকাতায় সংসার করছেন। সেখানে গিয়েই উঠলেন। বিরাট শহর, তাই কলকাতায় গিয়ে গান শেখার পূর্ণ সুযোগ পেলেন। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান সহকারী সুরশিল্পী চিত্ত রায়ের কাছে প্রাথমিক পাঠ নিতে শুরু করলেন। সেখানেই তার সঙ্গে বিশিষ্ট সুরকার কমল দাস গুপ্তের প্রথম দেখা হয়। চিত্ত রায় ও কমল দাস গুপ্তের সহযোগিতায় ১৯৪২ সালে তার প্রথম দুটি গানের রেকর্ড বের হলো। গান দুটি হলো—‘মরুর বুকে জীবন ধারা কে হারালো’ এবং ‘ঠ্যায়রো ঠ্যায়রো জ্যারা’। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তিনি নিয়মিত গান করেছেন, যেমন—বেতারে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার সর্বাধিক প্রকাশিত কাগজ আনন্দবাজার তার গানের প্রশংসাও করেছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলেন। ওই বছরই ঢাকায় রেডিও স্টেশনের শর্টওয়েভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এবং তালাত মাহমুদ একত্রে গাইলেন—‘খেওয়ান হার নেইয়া মোরি ক্যার দো পার’ গানখানি। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারে নিয়মিত গান করেছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে আবার কলকাতায় চলে গেলেন ফিরোজা বেগম। সে বছরই কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে তার সুরে বেশকিছু গান করেন। এভাবেই তার সঙ্গীত গুরু হয়ে উঠলেন কমল দাস গুপ্ত। তিনি নজরুলের কথার সুর দিতেন আর ফিরোজা তা কণ্ঠে তুলে নিতেন। এভাবে প্রতিদিন তাদের দু’জনার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হতো। মনের অজান্তে একজন আরেকজনকে মন দিলেন। ১৯৫৬ সালে কমল দাস গুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হলো। ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করে কমল দাস গুপ্ত মুসলমান হয়ে হলেন—‘কামালউদ্দিন’। ১৯৫৭ সালে কলকাতা ছেড়ে দু’জনে চলে এলেন ঢাকায়। পাকিস্তানি আমল তখন। তাই ভারতে ফিরোজা বেগমের সমস্যা, আবার ঢাকায় কমল দাস গুপ্তের সমস্যা। ঢাকায় দু’জনে ফিরে এসে বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে দু’জনে যান, সেখানে মুখের ওপর দরজা বন্ধ। এজন্য বাড়িভাড়া পেতেও বেগ পেতে হলো। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কমল দাস গুপ্ত গৃহবন্দি ছিলেন ঢাকাতেই। সেসব কাহিনী তো এখন ইতিহাস। ১৯৭৪ সালে কমল দাস গুপ্ত মারা গেলে ফিরোজা বেগম একাকী হয়ে পড়লেন সন্তানদের নিয়ে। ফিরোজা বেগম যখন দেখলেন দেশে যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না, ঠিক সেই ক্ষণে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ছুটলেন একক অনুষ্ঠান করতে। যখন যেখানে গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাই তো বলতে হয়, শ্রোতার মনে, জনগণের হৃদয়ে তার ন্যায্য আসনটি যে পেয়েছেন—তাই তার জন্য যথেষ্ট নয় কি? কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাকেও তিনি গান শুনিয়েছেন—তখন তো তার কিশোরী বয়স। নজরুলের গান গাইতে গিয়ে তিনি এক সময় দেখলেন, নজরুলের লেখা প্রতিটি গান যেন বৈচিত্র্যে ভরা। এভাবেই তিনি নজরুলের গানের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। যতই নজরুলের গানের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকেন, বিস্ময়ের মাত্রা তার ততই বেড়ে যেতে থাকে। কথা, সুর, রাগের বৈচিত্র্য, তাল, ছন্দ—সব মিলিয়ে নজরুলের গান তাকে ভাবিয়ে তোলে। আর এভাবেই অনেক চেষ্টায় ফিরোজা বেগম নজরুলের অফুরান ভাণ্ডারের কিছু আয়ত্ত করে ফেললেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড করলেন, গানটি ছিল—‘গহনে গহনে সন্ধ্যা তারা’। এরপর থেকে তিনি নজরুলের গান নিয়েই পড়ে থাকলেন। এজন্য ফিরোজা বেগমকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেদিনের জনগণ সে কথা আজও ভোলেনি। নজরুলের গানের সেমিনার করা থেকে শুরু করে নানা রকম পরিকল্পনা করে এগিয়ে ছিলেন ফিরোজা বেগম। তিনি এগিয়েও ছিলেন। এভাবে তিনি নজরুলের গানকে জনপ্রিয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। আর তারই চেষ্টাতেই নজরুলসঙ্গীত আজ জনপ্রিয়। ঘরে ঘরে এ গান বাজে। এর পেছনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে ফিরোজা বেগমেরই। ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’, ‘খেলিছে জলদেবী’, ‘বলেছিলে তুমি আসিবে’, ‘বিরহের গুলবাগে’, ‘বনের তাপসী কুমারী’, ‘তুমি শুনিতে চেও না’, ‘কথা কও, কথা কও’, ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’, ‘মোমের পুতুল মমীর’, ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম খেজুর’, ‘বনফুলে তুমি মঞ্জরি’, ‘তোমার আসার আশায়’, ‘গলে টগরমালা’, ‘যুগ যুগ ধরি’, ‘প্রভু তোমারে খুঁজিয়া মরি’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ’, ‘প্রিয়তম এত প্রেম দিও না’, ‘আমি পূরব দেশের’, ‘কে বিদেশি বন উদাসী’, ‘বনমালার ফুল’সহ নজরুলের হাজারও গান তিনি গেয়েছেন, যা কিনা সিডিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারপরও একজন শিল্পীর তৃপ্তি কী মেটে! মেটে না। তাই তো ফিরোজা বেগম আরও গাইতে চান। তিনি শিল্পী, তাই তার মন পড়ে আছে গানের পানে। গান নিয়েই তিনি আছেন, থাকবেন আগামী দিনগুলোতেও—এই প্রত্যাশা তার লাখো ভক্তের। তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তিনি জনসমক্ষে এসে আবারও গেয়ে উঠবেন নজরুলের গান—‘আমি যুগ যুগ ধরে লোকে লোকে মোর প্রভুরে খুঁজিয়া বেড়াই’সহ হাজারও গান। আর এ জন্যই ফিরোজা বেগম নজরুলসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী।