পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২১, ২০১১

ট্রাজেডি কিং দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার...। ভারতীয় অভিনয় জগতে এক বিশাল মহীরুহ, এক জীবন্ত ইতিহাস। তার অবদান কোনো দিন ভোলা যাবে না। ‘আন’ ছবিতে নাদিরার সঙ্গে, ‘মোঘল-এ-আজম’ ছবিতে মধুবালার সঙ্গে, ‘দেবদাস’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে, ‘দাগ’ ছবিতে নিমির সঙ্গে, ‘মেলা’ ছবিতে নার্গিসের সঙ্গে, ‘আজাদ’ ছবিতে মীনা কুমারীর সঙ্গে, ‘জুগনু’ ছবিতে নূর জাহানের সঙ্গে এবং ‘গঙ্গা-যমুনা’ ছবিতে বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে দিলীপ কুমারের অভিনয়ের কথা দর্শকরা হয়তো চিরকাল মনে রাখবে। সেই দিলীপ কুমারের বয়স এখন নব্বই। যিনি একদা দিলীপ কুমারের ছবি দেখতেন, পরবর্তী সময়ে তার ছেলে আর এখন তার নাতিরাও দিলীপ কুমারের ছবি দেখেন বড় আগ্রহ নিয়ে। গিনেজ বুকেও তার নাম উঠেছে। অভিনয় করে কত যে পুরস্কার পেয়েছেন তার হিসাব নেই। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন ২০ বছর বয়স্ক সায়রা বানুকে। ১৯৬৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। এখনও তারা একই বাড়িতে রয়ে গেছেন। বৃদ্ধ দিলীপ কুমারের দিন কাটে এখন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বই-পুস্তক পড়ে। এ বয়সে খুব প্রয়োজন না হলে আর বের হন না। বহু বছর ধরে তিনি মুম্বাইর পালি হিলের বিশাল বাংলো বাড়িতে বসবাস করছেন। দিলীপ ও সায়র এখন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পড়ন্ত বেলায় দিলীপের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কতই না স্মৃতিময় ঘটনা, যা তিনি আর কোনো দিনই ফিরে পাবেন না। দিলীপ কুমারের আসল নাম ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে এক গোঁড়া মুসলিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা গোলাম সারওয়ার খানের ১২ সন্তানের মাঝে দিলীপ ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ফলের ব্যবসা করতেন। তাদের ফলের দোকান থেকে সুদূর নাগপুর, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, চেন্নাই, ভুপাল প্রভৃতি বড় বড় শহরে ফল চালান করা হতো। ছয় বছর বয়সে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে দিলীপ কুমার পেশোয়ার ছেড়ে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে এলেন। দিলীপ কুমার নামটি তার তখনও হয়নি ‘ইউসুফ’ কিংবা লাল বলে সবাই ডাকত। মুম্বাইর দিওলালির আঞ্জুমান-ই-ইসলাম স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে উইলসন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজে এসে পড়াশোনায় দিলীপের মন কিছুতেই বসতে চাইল না। বইয়ের চেয়ে বরং হাজার গুন পছন্দ হলো তার ফুটবল খেলা। যখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেন, তখন তিনি ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ঠিক করলেন আর পড়বেন না। কিছুদিন ফলের ব্যবসায় নেমে দিলীপ মোটেই আনন্দ পেলেন না। তাই ব্যবসা ছেড়ে চাকরির উদ্দেশে রওনা হয়ে যান পুনায়। সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে ম্যানেজারের পদে ৩৫ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন। এত অল্প মাইনেতেও তিনি ধৈর্য হারাননি। তিন মাস যাওয়ার পর ৩৫ টাকা থেকে তার মাসিক আয় দাঁড়াল আটশ’ টাকাতে। বেশ কিছু টাকা জমিয়ে এবার তিনি অফিসারদের মেসে একটা বার খুলে বসলেন। বেশ লাভবান হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু দিন পর বার উঠে গেল। এরপর ব্যবসা গুটিয়ে বম্বেতে ফিরে এসে কিছুদিন থাকার পর নৈনিতালে বেড়াতে গেলেন। সে সময় তার এক বন্ধু তাকে চিত্র নায়িকা দেবিকা রানীর কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেবিকা রানী তখন বম্বে টকিজের কন্ট্রোলার অব প্রোডাকশন পদে বহাল ছিলেন। দিলীপকে দেখেই তিনি বম্বে টকিজের আগামী ছবি জোয়ার ভাটায় অভিনয়ের জন্য মনোনীত করে বসলেন। ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে তাকে দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকায় নেয়া হয়েছিল। ইউসুফ খান নাম পাল্টে ছবিতে তার নাম রাখা হলো ‘দিলীপ কুমার’। সেদিন এ নামটি দিয়েছিলেন দেবিকা রানীই। বম্বে টকিজের আর্টিস্ট হয়ে তিনি মাসিক বেতন পেতেন ৬২৫ টাকা। ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। এ ছবিতে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মনে বিশেষ দাগ না কাটতে না পারলেও জনতা জানল দিলীপ কুমার নামে একজন নতুন নায়ক এসেছেন। দিলীপের দ্বিতীয় ছবি ‘প্রতিমা’। এ ছবিতেই তিনি সর্ব প্রথম একক নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। নায়িকা ছিলেন স্বর্ণলতা। তৃতীয় ছবি ‘মিলন’-এ তার সঙ্গে ছিলেন রঞ্জনা ও মীরা মিশ্র। ১৯৪৫ সালে শহীদ ছবিতে অভিনয়ের পর থেকে দিলীপের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শহীদ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। এর পর তারা জুটি হিসেবে নদীয়া কে পার, আরজু ও শবনম ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগেই নায়িকা-গায়িকা নূর জাহানের বিপরীতে দিলীপ অভিনয় করলেন জগনু ছবিতে। এরপর একে একে আরও অনেক নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করলেন ঘর কি ইজ্জত, বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, দিদার, হালচাল, দাগ, আন, সংদীল প্রভৃতি ছবিতে। ঘর কি ইজ্জত-এ তার নায়িকা ছিলেন মমতাজ শান্তি। নার্গিসের সঙ্গে বাবুল, মেলা, আনোখা পেয়ার, আন্দাজ, দিদার, জোগন প্রভৃতিতে অভিনয় করেন। এক সময় নার্গিসের সঙ্গে দিলীপের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজ কাপুরের জন্য তা বেশি দূর আগাতে পারেনি। ১৯৪৯ সালের কথা—সংদীল ছবিতে নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাষ্ট হলেন দিলীপ ও মধুবালা। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই এরা একে অন্যকে ভালোবাসলেন। মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান ওদের প্রেমের কথা জেনে ক্ষেপে গেলেন। মধুবালাকে বেশ মারধরও করলেন। পরবর্তী সময়ে দিলীপ ও মধুবালার মধ্যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য হয় এবং ওদের প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫৪ সালে। দিলীপ ও মধুবালা জুটির তারানা, সংদীল, মোঘল-এ আজম ছবি তিনটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। মোঘল-এ আজম, ভারতবর্ষের ফিল্ম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৬০ সালে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ছবিঘরে দর্শকের ভিড় উপচে পড়েছিল। বাংলা ছবি সাগিনা মাহাতোতে অভিনয় করার জন্য ১৯৬৭ সালে দিলীপ কুমার কলকাতায় এসেছিলেন। এ ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সায়রা বানু। তখন তো সায়রা বানু তার স্ত্রী। ১৯৮৬ সালে দিলীপ কুমার আসমা বেগম নামে এক মহিলার প্রেমে জড়িয়ে পড়ার কারণে সায়রার সঙ্গে সম্পর্কে কিছুদিন ফাটল দেখা দেয়। পরে সায়রার মা নাসিমা বানুর হস্তক্ষেপে দিলীয় ও আসমার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে সেসব রচনার অবসান ঘটিয়েছিলেন। ইন মানিয়াত্, আন্দাজ, জোগন, দাগ, দিদার ছবিতে দিলীপ ছিলেন বিয়োগান্তক চরিত্রে। এসব ছবিতে তার অভিনয় প্রাণবন্ত হয়েছিল আর এ জন্যই দর্শকরা তাকে বলতো ট্র্যাজেডি কিং কিংবদন্তির এই তারকার ছবিগুলো ভিডিও সিডির বদৌলতে দর্শকরা এখনও ঘরে বসে দেখে থাকেন। ১৯৪৩ থেকে এ পর্যন্ত দিলীপ কুমার অভিনীত ছবির সংখ্যা ৭৮টি। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রথম ছবি ক্রান্তি ১৯৭৯। তার অভিনীত প্রতিটি ছবিই উল্লেখযোগ্য অর্থাত্ স্মরণীয়। কেননা তিনি একত্রে ১০টি কী ১২টি ছবি হাতে নিতেন না। বছরে ১টি বা ২টি ছবি হাতে নিতেন। যে জন্য তিনি চরিত্রের গভীরে যেতে পারতেন। এ কারণে শুধু সেদিনের দর্শকদের স্মৃতিতে নয়, একালের দর্শকদেরও ভালো লাগে তার অভিনীত মেলা, আন্দাজ, নদীয়াকে পাড়, বাবুল, দিদার, তারানা, নয়া দৌড়, দিলদিয়া দর্দলিয়া, সংঘর্ষ, দেবদাস, মিলন, জুগনু, মোঘল-এ আজম, পানসহ প্রতিটি ছবি।