পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ১৮, ২০১১

অ ম র শি ল্পী আবদুল আলীম

১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিতে মাঝির গান—‘আমি ভিন গেরামের নাইয়া’ রুপালি পর্দায় এই গানের দৃশ্য দেখে হাজারও দর্শক-শ্রোতা গানের শিল্পী আবদুল আলীমের প্রশংসা করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রুপালি পর্দার আর রেকর্ডের গানে তার অসম্ভব খ্যাতি ছিল। মঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনেও তিনি ছিলেন ব্যস্ত। পল্লীসঙ্গীত গেয়ে তিনি বাঙালির হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিলেন। তার গাওয়া ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘রুপালি নদীরে’, ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল’, ‘ভাটির গাঙে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাওরে বন্ধু’, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’, ‘তেরে ইস নাদিয়ানে মুঝকো কেয়া কেয়া রঙ্গ দেখায়ে কিতনে রঙ রঙিলে মাঝি গুজরে পাল উড়ায়ে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’—এরকম কত শত গান এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। পল্লীগীতির এই অমর শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে। পিতার নাম ইউসুফ আলী। শৈশবেই আলীম তার পিতাকে হারান। এ অবস্থায় তার মনের কোণে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই বিচ্ছেদই তাকে সঙ্গীতের দিকে টেনে নিয়েছিল। প্রায়ই গুন গুন করে তিনি গাইতেন, বৃদ্ধ পিতামহ (দাদা) অলক্ষ্যে তা দাঁড়িয়ে শুনে যেতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতেন তার চেয়েও বেশি। স্কুলে যখন ভালো লাগতো না তখন আলীম চলে আসতেন ভাগিরথী নদীর পাড়ে। ওখানে বসে নদীর দৃশ্য দেখে আর মাঝির কণ্ঠে গান শুনে ভাবতেন, কী করে রেকর্ডে গান করা যায়। কবেইবা কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীতে গান করবেন তিনি— এসব ভাবনা তাকে প্রায় সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। পাশের গ্রামে এক বাড়িতে ছিল কলের গান। প্রতিদিন ওই বাড়িতে গিয়ে কলের গানে কে. মল্লিক, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, রঞ্জিত রায়, অনিমা সেনগুপ্তা, পাহাড়ী সান্যাল, যুুথিকা রায়, তসের আলীসহ কত না শিল্পীর গান শুনে শুনে আবদুল আলীম নিজেও ওইভাবে গাইতে চেষ্টা করতেন। মা চাইতেন, ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু আলীম লেখাপড়া বাদ দিয়ে গান-বাজনায় মশগুল হয়ে পড়ল। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আবদুল আলীম নদীর পাড়ে বসে গান গাইতে গাইতে এক সময় মঞ্চে তার ডাক পড়ে। ১৯৪২ সালের কথা। মাত্র ১২ বছর বয়সে গুরু সৈয়দ গোলাম আলীর হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি । তার গ্রামের এক আত্মীয় তখনকার কলকাতার মেয়র। তাকে গান শোনালেন, গান শুনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাকে কলকাতায় রেখে দিলেন। এরপর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাকে নিয়ে যেতে লাগলেন গান গাওয়ানোর জন্য। এক সময় কলকাতার সব আসরে আলীমের উপস্থিতি আবশ্যিক হয়ে উঠল। এভাবে একদিন পরিচয় হয়ে গেল অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হকের সঙ্গে। তার স্নেহ লাভ করল আবদুল আলীম। তখন তো কলকাতার মঞ্চে গান গাইতেন তসের আলী, ওসমান খান, নুরুন্নাহার, নুরুদ্দিন, নায়েব আলী, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন প্রমুখ। তাদের পাশাপাশি যোগ হলেন এই আবদুল আলীম। মোহাম্মদ সুলতানের সহযোগিতায় কাজী নজরুল ইসলামের সুরে প্রথম রেকর্ডে তিনি গাইলেন ‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো সঙ্গে নিয়ে যাই’ এবং ‘আফতাব ওই বসলো পাটে আঁধার আইল শেষে’ গান দু’খানি। এর আগে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ‘উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়’ গানটি গেয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে শুনিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হলে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন ঢাকায়। এরপর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত পল্লীগীতি পরিবেশন করতে থাকেন। ১৯৫২ সালের বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনের লাহোর অধিবেশনে আলীমের যোগদান করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে পল্লীগীতি গেয়ে তিনি অকৃপণ প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ৫০টি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবদুল আলীম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখ ও মুখোশ, এদেশ তোমার আমার, জোয়ার এলো, সুতরাং, নদী ও নারী, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাত ভাই চম্পা, স্বর্ণকমল, গাঁয়ের বধূ, লালন ফকির, দস্যুরানী, উত্সর্গ, তীর ভাঙা ঢেউ। এসব ছবিতে শিল্পীর গাওয়া গান এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। আবদুল আলীম ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গীত প্রেমিকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তিনি চলে গেলেও তার গান এ প্রজন্মের শিল্পীরাও বিভিন্ন চ্যানেলে গেয়ে বাহবা পাচ্ছেন। অসংখ্য ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ইসলামী আর লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে আবদুল আলীম অমর হয়ে থাকবেন।