পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ১৮, ২০১১

বাঙালির প্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেন

সেই কবে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’র বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে সুচিত্রা সেন ঝড় তুলেছিলেন বাঙালি হৃদয়ে। তারপর ৫৭ বছর কেটে গেছে। এদিকে তার বয়স এত দিনে আশির কোঠায় চলে এসেছে। তবুও সৌন্দর্য এবং সুচিত্রা সমার্থক হয়ে আছে বাঙালি দর্শকের চোখে। ‘অগ্নি পরীক্ষা’ ছবিতে অভিনয় করলেন ১৯৫৪ সালে। এ ছবিটি তাকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তো ‘পথে হলো দেরি’, ‘হারানো সুর’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’ ছবিগুলোর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই সুচিত্রা সেন। ১৯৭৮ সালে অভিনয় ছেড়ে দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত কোটি দর্শকের হার্টথ্রব। এপার বাংলা ওপার বাংলার জনগণমননন্দিতা চিত্র নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেনি। এখনও সুচিত্রা অনেকের হৃদয়ের রানী। কলকাতার বালিগঞ্জের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে তিনি বৃদ্ধা বয়সের দিনগুলো কাটাচ্ছেন এখন। তার দেখাশোনার জন্য রয়েছে কয়েকজন পরিচারিকা। চলাফেরা করতেও তার অসুবিধা হচ্ছে। তার ঘরে একমাত্র কন্যা মুন মুন সেন, নাতনিরাসহ নিকটাত্মীয়রা প্রবেশ করারই অনুমতি পাচ্ছেন। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতেও তিনি কখনও আগ্রহী ছিলেন না। গ্রেটা গার্বোর মতো তিনিও বরাবর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন। তার এ বয়সের দিনগুলো কাটছে পূজা-অর্চনা করে। কয়েক বছর আগেও তিনি ঘরে বসে টেলিভিশনে প্রদর্শিত তারই ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। এখন নাকি তার তাও ভালো লাগছে না। সুচিত্রা সেন তার জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে গেলেন। এই মহান নায়িকা সম্পর্কে জানা যায়, তার নায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা গেলে সেই রাতে এসেছিলেন একখানি মালা হাতে নিয়ে। মহা নায়িকা সুচিত্রা সেন মহানায়কের গলায় সেই মালা রেখে গিয়েছিলেন সেই রাতে। সুচিত্রা সেন ফিরে এলেন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে, তারপর তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল বিহারের পাটনায়। জন্মের কয়েক বছর পর চলে এলেন পাবনাতে। শৈশবকাল কেটেছে পাবনা শহরে। সে সময় তার নাম ছিল রমা সেন। কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম বসন্তে তিনি অনেক নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাবনা ছেড়ে বাবার সঙ্গে চলে গেলেন কলকাতায়। ওই বছরই তার বিয়ে হয় আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথের সঙ্গে। শ্বশুরের যে সম্পত্তি ছিল তাতে স্বামী এবং তার ভালোভাবে দিন কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু দিবানাথ সেন এতই মদ খেতেন যে টাকা সংগ্রহের জন্য জায়গাজমি বিক্রি করে দেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে রমা সেনকে সিনেমায় নামতে হয়। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেন চলচ্চিত্র জগতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছবিটি মুক্তি পেল না। এরপর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে প্রতিষ্ঠা পেলেন। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন সমর রায়। সুচিত্রা সেন তার অভিনীত জীবনে মোট ৬০টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত একবার বলেছিলেন, “১৯৫১ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। এমন সময় অসিত চৌধুরী আমাকে বললেন, একটি ভালো শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে আছে। মনে হয় সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে খুব নাম করবে। তার কথায় মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। প্রথম দিন ওর স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে অরোরা স্টুডিওতে। দেখলাম, ছিপছিপে চেহারায় ডাগর ধরনের চোখ। চোখ দু’টি বড় সুন্দর আর খুব এক্সপ্রেসিভ, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উজ্জ্বলতায় ভরে যায়। এক নজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও বেশ মিষ্টি। কথার মধ্যে একটু বাঙাল টোন আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিতে রাজি হয়ে গেলাম।” ‘সাত নম্বর কয়েদি’র পরে পিনাকী মুখার্জির ‘সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করেন। তখনও তিনি সুচিত্রা সেন নামে আসেননি। এর পরের ছবি অর্থাত্ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে তিনি রমা সেন পাল্টিয়ে সুচিত্রা সেন নামে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি ১৯৫২ সালে মুক্তি পায়। তখন বাংলা সিনেমায় দুঃসময় চলছিল। কানন দেবী, উমাশশী, সাধনা বসুর যুগ শেষ। ঠিক সেই সময় অনেকের চোখে তিনি ধরা পড়েন। তাছাড়া ওই সময় সুরাইয়া, নার্গিস, নিন্মি ও নাদিরার হিন্দি ছবি দেখার জন্য বাঙালি দর্শকের ভিড় উপচে পড়ত। সুচিত্রা সেনের আগমনে ভিড়টা ক্রমে চলে এলো বাংলা ছবির দিকে। সুচিত্রা সেন থাকলেই হলো। শুরু হলো সুচিত্রা সেনের অপ্রতিহত জয়যাত্রা। আরম্ভ হলো ভক্তদের কত উদ্ভট সব জল্পনা-কল্পনা। সুচিত্রা সেন কেমনভাবে দিন কাটান, কী খান, কীভাবে কথা বলেন ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা ও গবেষণা চলতে থাকে চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তায় কিংবা বাড়িতে, স্কুল-কলেজে। এমনিভাবে সুচিত্রাকে নিয়ে উদ্দাম কল্পনা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আনন্দের ব্যাপার এই যে এখন পর্যন্ত সেই কল্পনার সমাপ্তি ঘটেনি। ১৯৫৪ সালে তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে গেল। এ ছিল যেন বিস্ময়কর প্রতিভার এক স্বাক্ষর। ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘অন্ন পূর্ণার মন্দির’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অগ্রদূত’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘মরণের পরে’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’ প্রভৃতি ছিল ১৯৫৪ সালের ছবি। প্রতিটি ছবিই সে সময় ব্যবসাসফল হয়েছিল। উল্লিখিত ছবিগুলোয় সুচিত্রা সেনের নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। পরবর্তী সময়ে এই জুটি ঝড় তুললো সাঁঝের প্রদীপ (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), ত্রি ঘামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৬), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), সূর্যতোরণ (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাসা (১৯৬২), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির উত্তম কুমার মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। সুচিত্রা সেনও ফিল্ম লাইন ছেড়ে দিয়েছেন ৩৫ বছর আগে। তবুও এই জুটির পুরনো ছবিগুলো এখনও সমান জনপ্রিয়। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা সেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’, ‘প্রণয় পাশা’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘হসপিটাল’ সুচিত্রার জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি। এ ছবিতে তার নায়ক ছিলেন অশোক কুমার। এ ছাড়া অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে স্মৃতি টুকু থাক, বসন্ত চৌধুরীর বিপরীতে ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ ছবির কথাও যে ভোলার নয়। সুচিত্রা সেন হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। যেমন—মুসাফির, দেবদাস, বোম্বাইকা বাবু থেকে মমতা পর্যন্ত প্রায় ছয়-সাতখানা ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। হিন্দি ‘দেবদাস’-এ তিনি পার্বতীর ভূমিকায় ছিলেন আর দেবদাস সেজেছিলেন দিলীপ কুমার। ১৯৭০ সালের ২৯ নভেম্বর স্বামী দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পর সুচিত্রা সেন অসহায় হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ছবিতে আর অভিনয় নয়। নিকটতম ঘনিষ্ঠ কয়েকজন চিত্র পরিচালকের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি বলেই পরে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে ১৯৭৮ সালে ছবির জগত থেকে চিরতরে বিদায় নেন। শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। সুচিত্রা সেন অনেক আগেই অতীতের গৌরবময় দিনগুলো হারিয়ে ১৯৮০ সালের পর থেকে একাকী জীবন কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন। আর এ জন্যই তিনি এরপর থেকে কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাত্কার দেননি। কাউকে ছবিও তোলার অনুমতি দেননি। এর কারণ এও হতে পারে যে নানা রংয়ের রঙিন দিনগুলো যে আর ফিরে পাবেন না। এটা কী কম কষ্টের ব্যাপার—এই অনুশোচনায় তিনি নীরব হয়ে গেলেন। আসলে গ্ল্যামার জগতেরই এ নিয়ম। পাবনা শহরে তার বাড়িটি যে ভাবে নীরব-নিস্তব্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক রূপকথার নায়িকা সুচিত্রা সেন ক্লান্ত হয়ে অবশেষে অনুরূপভাবে দাঁড়িয়ে আছেন-থমকে আছেন। তাকে নিকটাত্মীয়রা ছাড়া কেউই যে দেখতে পান না। আর এ জন্যই কোটি দর্শকের ইচ্ছে, সুচিত্রা সেনকে আরেকবার যে দেখতে চাই। কিন্তু সে ইচ্ছে যে আর পূরণ হওয়ার নয়। ইচ্ছেটা স্বপ্ন হয়েই থাকবে। কারণ সুচিত্রা সেন যে রহস্যময়ী। আর এ জন্যই তো তিনি কিংবদন্তি।