পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ১৮, ২০১১

রাজকাপুরের নায়িকা নার্গিস

রাজকাপুরের ছবিতেই নার্গিস অভিনয় করে এখন পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে আছেন। বরসাত, শ্রী ৪২০, আওয়ারা, আন্দাজ, জাগতে রহো, আহ ছবিগুলোয় নার্গিসের নায়ক ছিলেন রাজ কাপুর। রাজ কাপুর-নার্গিস জুটির অনবদ্য অভিনয় দীপ্তির প্রসার ঘটেছিল আর কে ব্যানার থেকেই। নার্গিস নামে নানা কল্পিত কথা আর কে ফিল্মস থেকেই শুরু হয় এবং ওখানেই শেষ। তারপর কিংবদন্তি হয়ে রইলেন চিরকালের নায়িকা নার্গিস। নার্গিসের জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জুন কলকাতায়। তাঁর মা জড্ডন বাঈ একসময় প্রখ্যাত গায়িকা ছিলেন। আর নার্গিসের বাবার নাম ডা. উত্তম চাঁদ মোহন। জড্ডন বাঈকে বিয়ে করে ডা. উত্তম চাঁদ মোহন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। জড্ডন বাঈয়ের প্রথম দুই পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তারা হলেন আখতার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন। সবশেষে নার্গিসের জন্ম। জড্ডন বাঈ কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেন। এর মধ্যে ‘তালামি হক’ ছবিটি উল্লেখযোগ্য। এই ছবিতে নার্গিস বেবী রানী নামে শিশু শিল্পীর ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন। তখন নার্গিসের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। জড্ডন বাঈয়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক। এ জন্য নার্গিসকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়তি মানুষকে কোন পথে চালিত করে কেউ তা বলতে পারে না। ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করার ইচ্ছে তার পূরণ হলো না। শেষতক তিনি ছবির নায়িকা হয়ে গেলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মেহবুব খান পরিচালিত ‘তকদির’ ছবিতে নায়িকা হওয়ার পর নার্গিসের নাম প্রথম ছড়িয়ে পড়ল উপমহাদেশজুড়ে। ১৯৪৩ সালে ‘তকদির’ মুক্তি পায়। নার্গিসের নায়ক ছিলেন মতিলাল। এরপর ১৯৪৮ সালে মেহেবুব খানের ‘আগ’ ছবিতে রাজ কাপুরের বিপরীতে নার্গিস অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে নার্গিস তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম চরিত্রাভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন—১৯৪৮ সালে ‘মেলা’, ‘১৯৪৯ সালে আন্দাজ, বরসাত; ১৯৫০ সালে বাবুল, যোগান; ১৯৫১ সালে আওয়ারা, দিদার, হালচাল; ১৯৫২ সালে আনহোনি, ১৯৫৬ সালে ‘জাগতে রহে’, ১৯৫৭ সালে মাদার ইন্ডিয়া, পরদেশী প্রভৃতি ছবিতে। নার্গিস তার নিজের প্রতিষ্ঠান নার্গিস আর্ট প্রোডাকশন থেকে ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘আনজুমান’, ‘দারোগাজী’ এবং ‘ভীস্ম প্রতীজ্ঞা’ ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে নার্গিস মায়ের ও সুনীল দত্ত তার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের শেষ দিকে নার্গিস ভারতের রাজ্যসভার একজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে যান চিকিত্সার জন্য। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি মুম্বাই প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পর ১৯৮১ সালের ৩ মে মারা যান। নার্গিসের জীবনে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—আনবান (১৯৪৪), ইসমত্ (১৯৪৪), বিসম্বাদী (১৯৪৫), হুমায়ুন (১৯৪৫), রামায়নি (১৯৪৫), নার্গিস (১৯৪৬), আনজুমান (১৯৪৮), বিরহ কি রাত (১৯৫০), জান যাহবান (১৯৫০), খেল (১৯৫০), মীনা বাজার (১৯৫০), পিয়ার (১৯৫০), সাগর (১৯৫১), আম্বার (১৯৫২), রেওয়াফা (১৯৫২), সিসা (১৯৫২), আহ (১৯৫৩), ধুন (১৯৫৩), শাদী (১৯৫৩), পাপী (১৯৫৩), আঙ্গারে (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), চোরি চোরি (১৯৫৬), মিস ইন্ডিয়া (১৯৫৬), লাজওয়ান্তি (১৯৫৮) ও পিয়ার কি ওয়াতন (১৯৬৭)। ‘নার্গিস-রাজ কাপুর’ জুটিকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, এর নিরানব্বই ভাগই ছিল রটনা। নার্গিস-রাজ কাপুর জুটি থেকেই সিনেমা জগতে জুটি বাঁধার সূত্রপাত, যার ফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে দিলীপ-মধুবালা, দেব-সুরাইয়া, ধর্মেন্দ্র-হেমা, অমিতাভ-রেখা প্রভৃতি জুটি গড়ে উঠেছিল। রাজ কাপুর ছাড়া নার্গিসের নায়ক ছিলেন—দিলীপ কুমার, মতিলাল, অশোক কুমার, জয়রাজ, বলরাজ মাহানী, করন দেওয়ান প্রমুখ। বিয়ের পর নার্গিস অভিনয় ছেড়ে দিলেও স্বামী সুনীল দত্তের চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায় তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন নেপথ্যে থেকে। সুনীল দত্ত প্রযোজিত পরিচালিত মুঝে জিনে দো, ইয়াদিন, রেশমা আউর শেরা, মন কা মিত ইত্যাদি ছবিতে নার্গিসের অবদান উল্লেখ করার মতো। অভিনয় জীবন ছেড়ে দিলেও নার্গিস চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনি সমাজসেবায় নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন। মুম্বাইর বস্তিতে ঘুরে তিনি দরিদ্র অসহায় লোকজনের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তার প্রতিকারের চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে তিনিও অবদান রেখে গেছেন। নার্গিসের স্বামী সুনীল দত্ত আজ আর বেঁচে নেই। তার বড় ছেলে সঞ্জয় দত্ত ফিল্মে এক সময় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সঞ্জয়দত্তের বয়স এখন ৪৯ বছর। মেয়ে নম্রতার বয়স ৪৬ বছর ও প্রিয়ার বয়স ৪২ বছর। আজও কোথাও রাজ কাপুরের কথা উঠলে ‘নার্গিস’ নামটি সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে। তবে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন না বটে; কিন্তু তারা বিদেশে গিয়ে একত্রে কাটিয়েছেন—এমন খবরাখবর সেদিনের পত্রপত্রিকাগুলো এখনও প্রমাণ বহন করে যাচ্ছে।