পৃষ্ঠাসমূহ

এপ্রিল ২১, ২০১১

সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ সোহরাব হোসেন

নদীয়ার নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নামে আজও চলে বন্দনা। সেই নদীয়া জেলার আয়েশতলা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন একটি ফুটফুটে সুন্দর ছেলে। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন—‘সোহরাব’। তার বাড়ির পাশে ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ি। সারাদিন ঢাকঢোল-বাদ্য বাজতো আর কীর্তন গানে মুখরিত থাকত জমিদারবাড়ি। ছেলেটি প্রায় দিনই ছুটে আসত, কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে তার মনেও ইচ্ছে জাগল—কী করে গাইব। পরবর্তী সময়ে রেকর্ডে ও রেডিওতে গান গাইবার সুযোগ পেলেন ছেলেটি। এভাবে নাম হয়ে গেল সোহরাব হোসেনের। ঘরে ঘরে বাজতে লাগল তার কণ্ঠে গাওয়া—‘মোহাম্মদ মোর নয়নমণি মোহাম্মদ নাম জপমালা’। এ গান দিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন মস্ত বড় শিল্পী। কণ্ঠশিল্পী সোহরাব হোসেনের বয়স এখন প্রায় ৯০। এই বয়সেও সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত তিনি। এখন তো আর আগের মতো করে গাইতে পারেন না। তবে এ প্রজন্মের শিল্পীদের যথাসাধ্য সঙ্গীতের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তার খ্যাতি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদকও পেয়েছেন তিনি। দেশ তাকে যথাসাধ্য মর্যাদাও দিয়েছে। যে জন্য সোহরাব হোসেনের কোনো ক্ষোভ কিংবা দুঃখ থাকার কথা নয়। জীবনের পড়ন্ত বেলার দিনগুলো মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গীত বিচারক হিসেবে বিভিন্ন চ্যানেলে, নজরুল একাডেমিতে ডাক পড়লেও এ বয়সে সেভাবে আর যেতে পারছেন না। তবুও মাঝে মধ্যে ইচ্ছে পূরণ করছেন। সোহরাব হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল আয়েশতলা গ্রামে। ওই জায়গা এখন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় রয়ে গেছে। মাত্র ৫ বছর বয়সে নানা তমিজউদ্দিন মিয়ার কণ্ঠে—‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানখানি শুনেই সঙ্গীতের প্রতি দুর্বল হন। তারপর থেকে ঘরে বসে আপন মনে গান গাইতেন। বাড়ির কাছেই ছিল জমিদারদের বাগান। গান শেখার জন্য প্রতিদিন রাতে যেতেন সেখানে। তখনকার সমাজ এটা মেনে নিতে পারেনি। গান গাইতে দেখলেই তখন তিরস্কার করা হতো। মুসলমানের ছেলে হয়ে গান করার কারণে সোহরাব হোসেনকে অনেক গালমন্দের সঙ্গে বাধা-বিপত্তি সহ্য করতে হয়েছিল। নানা রকমের কথাও শুনতে হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে, গান-বাজনা হারাম। সোহরাব হোসেন ওইসব কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি ভাবতেন, আব্বাসউদ্দিন, কে মল্লিক—ওরা মুসলমান হয়ে যদি গান গাইতে পারেন তাহলে আমি কেন পারব না! গান তিনি ছাড়েননি। প্রথম গান শেখেন জয়নাল আবেদিনের কাছে। এরপর কিরণ দে চৌধুরীর কাছে। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বেতারে সঙ্গীত পাবলিসিটিতে সোহরাব হোসেনের চাকরি হয়। ওই সময় তিনি আব্বাসউদ্দিন আহমদ ও গিরিন চক্রবর্তীর কাছে কিছুদিন গান শিখলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রায়ই নাটক দেখতে যেতেন। উদ্দেশ্য ছিল—ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালাসহ তখনকার নামিদামি শিল্পীদের কণ্ঠে গান শোনা। তাদের কণ্ঠে গান শুনে শুনে মুগ্ধ হতেন। ধীরে ধীরে গানে পারদর্শী হলেন। আর এভাবে একদিন কলকাতা বেতারে ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে গান করার সুযোগ পেলেন। সেটা ছিল ১৯৪৬ সালের কথা। উপমহাদেশ ভাগাভাগির পর আর কলকাতায় থাকা হলো না তার। ১৯৪৮ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে এইচএমভি থেকে সোহরাব হোসেনের একটি রেকর্ড বের হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বেশি হয়নি সোহরাব হোসেনের। তিনি এ প্রসঙ্গে জানিয়ে ছিলেন, নজরুল ইসলামের কণ্ঠে মাত্র দু’বার স্টেজে গান শুনেছি। ১০ কি ১১ বছর বয়সে তাকে রানাঘাট স্টেশনে প্রথম দেখি। কলকাতায় যখন যাওয়া-আসা শুরু করি তখন তার সঙ্গে দেখা হওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। সবুর খান, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন, গিরিন চক্রবর্তী—এরা একত্রে মেলামেশা করতেন। দূর থেকে দেখেছি, কিন্তু তাদের ধারে-কাছে যেতে কেমন জানি লজ্জা বা সঙ্কোচ লাগত। কেননা, উনারাতো কতই না নামিদামি ব্যক্তি! সোহরাব হোসেন এক সময় চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক করেছেন। মাটির পাহাড়, এ দেশ তোমার আমার, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল, যে নদী মরুপথে প্রভৃতি ছবিতে গেয়েছেন স্মরণীয় কিছু গান। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই সব গানের কথা এখন আর সোহরাব হোসেনের খুব একটা মনে পড়ে না। তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন লুত্ফর রহমান, ওসমান খান, মমতাজ আলী খান, আবদুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ। এরা আজ আর কেউই বেঁচে নেই। এই বয়সে সোহরাব হোসেনের খুব করে মনে পড়ে—নদীয়ার সেই দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে প্রিয় বন্ধুদের কথা। কিন্তু তিনি বলেন, অতীত ভেবে আর তো লাভ হবে না। যে দিন চলে গেছে সেদিন তো আর ফিরে আসবে না...। সোহরাব হোসেনের ৫ ছেলেমেয়ে। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে রওশন আরা সোমা থাকে কাতারে, মেজ মেয়ে রাহাত আরা গীতি ঢাকাতেই থাকে, সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত। ৯০ বছর বয়সেও তিনি কণ্ঠে তারুণ্য ধরে রেখেছেন, যা অনেকেই পারেন না। সঙ্গীতে নিবেদিত প্রবাদ-পুরুষ সোহরাব হোসেনও জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে রইলেন।