পৃষ্ঠাসমূহ

মে ০৪, ২০১১

ব্যান্ড সঙ্গীতের গুরু আজম খান

ব্যান্ড সঙ্গীত তারকাদের গুরু হলেন আজম খান। বাংলাদেশে পপ গানের পথিকৃত্ তিনিই। ‘ওরে ছালেকা ওরে মালেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে’, ‘আলাল কই দুলাল কই’ ইত্যাদি গান দিয়ে তিনি আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে আছেন। আজম খানের পথ ধরেই পরে এসেছেন হামিন, শাফিন, মাকসুদ, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, বিপ্লব এবং আরও অনেকে। এরা সবাই আজম খানকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। একটা সময় গেছে যখন তাকে একাই শুধু রাতের পর রাত পপ গান গাইতে হয়েছে। তাই পপ গুরু বলা হয় এই আজম খানকে।
১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আহার-নিদ্রা ভুলে গিয়ে তাকে একের পর এক স্টেজ শো করতে হতো। সেই দিনগুলোয় লাখ লাখ জনতা আজম খানকে একনজর দেখার জন্য স্টেজে কিংবা পথে-ঘাটে ভিড় করত। সেই জনতা আজ কোথায়? থাকলেও হয়তো নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো আজম খানকে দেখার সময় যে তাদের হাতে নেই। আজম খান বিদেশে বহুবার গেছেন। ১৯৮৬ সালে বাহরাইন, ১৯৯৩ সালে আমেরিকা এবং ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্টেজ শো-তে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি যে ধরনের গান গাইতেন তা হলো পপ আর ব্যান্ড সঙ্গীত। তার সৃষ্টি করা গান এখন জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, বিপ্লবরা গাইছেন। আজম খানের মতে, ব্যান্ড শিল্পীরা মূলত পপ গানই গাইছেন। মডার্ন মিউজিককে প্রাধান্য দিয়েছিলাম বলেই পপ সঙ্গীতে এসেছিলাম। মন আর দেহ দুটোকেই নাড়া দেয় পপ সঙ্গীত। এ সঙ্গীতে গানের সঙ্গে নাচও করতে হয়। পপ আর ব্যান্ড সঙ্গীত যে একই।
আজম খানের আসল নাম মাহাবুবুল হক খান। ডাকনাম আজম। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর কলোনির ১০ নম্বর বিল্ডিংয়ে। এসএসসি পাস করেন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমিল্লা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার। আজম খানের আদিবাড়ি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলায়। তার প্রথম অ্যালবাম বের হয় ১৯৮২ সালে।
তার জীবনে বহু স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও খুলনায় বহু স্টেজ শো করেছেন তিনি। ময়মনসিংহের একটি ঘটনা প্রায়ই তার মনে নাড়া দেয়। ময়মনসিংহের এক কলেজে স্টেজ প্রোগ্রাম করার জন্য গিয়ে দেখলেন হাজারও জনতার ভিড়। তখন দুপুর। যেখানে স্টেজ করা হয়েছিল তারই আশপাশে ছিল কয়েকটি বিল্ডিং। মাঠে পাবলিক ধরছে না বলে বিল্ডিংয়ের ছাদে ও গাছে বসে দাঁড়িয়ে পাবলিক এনজয় করে যাচ্ছিল। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে উঠতি বয়সের অনেক ছেলে নৃত্যও করছিল। হঠাত্ আজম খান দেখলেন, ছাদ ভেঙে পড়ে গেল। বিকট আওয়াজে পড়ে যায়। তাদের ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আজম খান পরে জানলেন তাদের সবাই ব্যথা পেয়েছে, তবে কেউই মারা যায়নি। এ ঘটনাটির কথা মনে হলে এখনও আজম খানের খারাপ লাগে।
আজম খানের গানের সংখ্যা তিনশ’র মতো। গান করতে গিয়ে কখনও কারও কাছ থেকে বাধা পাননি। স্ত্রী শাহিদা বেগম এবং ছেলেমেয়েরাও তাকে উত্সাহ দিয়েছে। দেশাত্মবোধক গানও করেছেন তিনি। আসলে আজম খান প্রথমে গণসঙ্গীত করতেন—এটাই ছিল তার মৌলিক দিক। তিনি সব সময় দুঃখী মানুষের জন্যই গান করেছেন। একটা সময় রটে গেল আজম খান নাকি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সেটা ছিল ১৯৮০ সালের কথা। পরে দেখা গেল তিনি সুস্থই আছেন। সেই সময় স্টেজ শো হলে পপ সঙ্গীত তাকেই গাইতে হতো। একবার আজম খান জানিয়েছিলেন, একটা সময় এসে দেখলাম মাইলস ইংরেজি গানই করত। তাদের বোঝালাম, ইংরেজি গান বাদ দিয়ে বাংলায় পপ গান কর। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত গান আর রিহার্সেল নিয়ে থেকে থেকে একপর্যায়ে অসুখে পড়ে গেলাম। পরে চিকিত্সকের কাছে গেলে তিনি সম্পূর্ণ রেস্ট নেয়ার জন্য বললেন। এ কারণেই সঙ্গীত ভুবন থেকে কিছুদিনের জন্য সরে দাঁড়ালাম। রক্তে সঙ্গীত মিশে ছিল বলেই আবার ফিরে এসেছিলাম সঙ্গীত ভুবনে।
আজম খানের সঙ্গীতে কোনো শিক্ষাগুরু ছিলেন না। কারও কাছে কোনো দিন গানও শেখেননি। ওস্তাদ ছাড়াই সঙ্গীত লাইনে এসেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, মোহাম্মদ রফি, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র, জগন্ময় মিত্র প্রমুখের গান শুনে শুনে গান শেখা শুরু করেন আজম খান। তার বাবা আফতাব উদ্দিন খানও গান শুনতেন—প্রচুর লং প্লে ছিল তাদের বাড়িতে। সবাই মিলে নিয়মিত গান শুনতেন। গান শুনতে শুনতেই গানের প্রতি তার দরদ জন্মায়। এভাবেই আজম খান একদিন ক্রান্তি সাংস্কৃতিকগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। সেটা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। এক সময় গণসঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গণসঙ্গীতও গাইতে শুরু করে দিলেন ঢাকা এবং এর বাইরে। গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। যুদ্ধ করলেন, দেশ স্বাধীনও করলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর সঙ্গীতে বিভোর হয়ে দেশজুড়ে পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীত ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন তিনি। এক সময় আজম খানের গাওয়া—‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে’ গানটা এতোই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এ গান গোটা বাংলাদেশের মানুষ যেন এক হয়ে গাইতে লাগল। এখনও এই গানের জনপ্রিয়তা কিন্তু থমকে যায়নি। ফিল্মেও তিনি গান করেছিলেন। ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’, ‘আরশী নগর’, ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’ প্রভৃতি ছবিতে তিনি গান করেছিলেন। তবে তার ভালো লাগত পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীত। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু আজ যা গাইছেন সেটা তারা দেখে দেখে আজম খানের কাছেই শিখেছিলেন। তাই বলতে হয় জেমস, বাচ্চু এবং এখনকার ব্যান্ড তারকাদের মহাগুরু হলেন আজম খান। বাংলাদেশের পপ কিংবা ব্যান্ড মিউজিকের পাইওনিয়ার হয়ে থাকবেন এই আজম খান।