পৃষ্ঠাসমূহ

অক্টোবর ১০, ২০১৩

নকুলের মাতৃশোক



‘যারা মাকে ভালোবাসো না, তারা আমার গান শোনে না’ গানটি গাইতে গাইতে চোখ ভিজে ওঠে নকুলের। ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছেন। কিন্তু শিশুমনে মাকে হারানোর যে প্রগাঢ় বেদনা তা আজও মুছে যায়নি। তাই মায়ের জন্য গাইতে গেলেই তার চোখ ভিজে ওঠে। বুধবার বাংলামেইলের সঙ্গে কথা বলার সময় এমনটাই জানালেন কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গীতিকার নকুল কুমার বিশ্বাস।
অথচ এই শিল্পী যখন সমাজ বাস্তবতা নিয়ে তার শ্লেষাত্মক মজার গানগুলো গাইতে থাকেন নিজস্ব বৈচিত্র্যপূর্ণ সুর স্বর আর অঙ্গভঙ্গিতে তখন হাসতে হাসতে দর্শকদের পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগার হয়।
কিন্তু এখন থাক ওসব শ্লেষ, বিদ্রুপ আর কৌতুক। নকুল এবার মাকে নিয়ে লেখা গানগুলোকে নিয়েই সাজাতে চান নতুন অ্যালবাম। ‘যারা মাকে ভালোবাস না’, ‘এই জীবনের সব অর্জন’, ‘আয় রে খোকা আয়’, ‘মামা বাড়ি’, ‘মা আমার বলতো খোকা রে’ মাকে নিয়ে লেখা এমন গানগুলো নিয়ে এবার বিশ্ব মা দিবসে আসছে নকুলের নতুন অ্যালবাম।
মাকে নিয়ে এ অ্যালবামটি নকুলের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেটির কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। তাই আমাদের পেছন ফিরতে হয়। পাঠ করতে হয় একজন সুরক্রিড়ানক নকুল কুমার বিশ্বাসকে।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালে মাদারীপুর জেলার দত্ত কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামের এক সংগীত পরিবারে জন্ম নকুল কুমার বিশ্বাসের। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। মা ও বাবা প্রয়াত সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও শ্রীমতি মঙ্গলী দেবী।
মঙ্গলী দেবীর কোলে আদর আর ভালোবাসায় ছোট্ট নকুলের যখন হেসে খেলে বেড়ানোর কথা তখনই মাকে হারাতে হয়েছে। মাত্র ছয় বছর বয়স তখন তার। মাকে হারিয়ে ব্যাথার সাগরে যখন ভাসছেন তখন তিনি মেজভাই হীরালাল বিশ্বাসের হাত ধরে গোপালগঞ্জে আসেন। লক্ষ্য ছিল যাত্রাদল দীপালি অপেরায় শিশুশিল্পী হিসেবে একটা সুযোগ পাওয়া। সুযোগ মিললোও।
শিশু নকুল অডিশনকক্ষে ছোট্ট আঙুলের ডগা দিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলে মিষ্টি কণ্ঠে শুনিয়ে গেলেন একের পর এক গান। সেদিন নকুলের গান শুনে অবাক বনে গিয়েছিল উপস্থিত সবাই। সেই থেকেই তো শুরু... আর আজকের এই নকুল যেন সেই বয়স্ক এক শিশুই!
যন্ত্রের সঙ্গেও সখ্য তার বহুদিনের। সুরযন্ত্র নিয়ে খেলেন নকুল কুমার। যারা নকুলকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখেছেন তারা জানেন কী করে পা দিয়েও হারমোনিয়াম বাজাতে হয়! মাদারীপুরের ওস্তাদ রণজিৎ দাইয়ের কাছে হারমোনিয়ামে রাগ সংগীতের তালিম নেন নকুল। অবাক করা ব্যপার হলো, মাত্র ছয় মাসেই এটা আয়ত্ত করেন এবং প্রধান হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে একটি স্কুলের শিক্ষক নির্বাচিত হন তিনি।
শুধু হারমোনিয়ামে ধরা হচ্ছিল না সে সুর। যে সুর নকুল মনে মনে ধরতে চাইছিলেন। যে ব্যথা বুকে বাজছিল তা যে শুধু হারমোনিয়ামে অনুরণিত হতে পারছিল না।
গুরু আশু মিয়ার কাছে বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের গল্প শুনতেন। মনে মনে ঠিক করলেন রবিশঙ্করের মতোই  বিখ্যাত হতে হবে তাকে। ১৯৮০ সালে সে সংকল্প চোখে নিয়েই পকেটে মাত্র ৫০০ টাকা সম্বল করে পাড়ি জমান কলকাতায়। ছোট্ট নকুল কলকাতায় প্রখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ মোস্তাক আলী খানের নাতি-শিষ্য শ্রী রণজিৎ বিশ্বাসের কাছে যান। কিছুদিন সেতার শেখেন তার কাছে ।
তারপর সেখান থেকে ২৮০ টাকায় কেনেন একটি সেতার। এরপর ফিরে আসেন দেশে। ফিরেই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান, অভিনয়, নৃত্য দিয়ে মানুষের মন জয় করতে থাকেন।
১৯৮৩ সালে বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। আশ্রয় নেন ওস্তাদ আমানউল্লাহ খানের বাড়ির ভাঙা বারান্দায়। তার কাছে কিছুদিন তালিমও নেন।
সে বছরই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উচ্চাঙ্গসংগীতের এক আসরে এককভাবে হারমোনিয়াম বাজানোর সুযোগ পান। উপস্থিত সবাই তার পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাকে কেন্দ্রের তহবিল থেকে এক হাজার টাকা পুরস্কারও দেন। এরপর বেতারে চাকরি হয় তার। কিন্তু চাকরির গণ্ডিবদ্ধ আধারে মন বসেনি নকুলের।
১৯৮৬ সালে তিনি আবারও গ্রামের বাড়ি চলে যান এসএসসি পরীক্ষা দিতে। ওই সময় এক কবিয়ালের কিছু গান সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কবিয়াল গান না দিলে অভিমান হয় তার। নিজেই লেখা শুরু করেন। সেই থেকে আজ অবদি অন্য কারো লেখা গান করেননি তিনি। এসএসসি পাস করে পরের বছর আবার আসেন ঢাকায়।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড এন্টারপ্রাইজের ব্যানারে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘ভাগবত পড়ে ভগবানকে পাইছোনি’।  অ্যালবামটি হিট হয়। একই সঙ্গে গান ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
১৯৯৬ সালে ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত হয় তার গাওয়া ‘দাদা বিয়া করলাম ক্যান’ গানটি। এই গানটি তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপর টানা দশ বছর ইত্যাদিতে জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে জীবনমুখী গান নিয়ে হাজির হয়েছেন।
এর মধ্যে কলকাতার অডিও বাজারে লাগে নকুলের গানের ঢেউ। কলকাতার অডিও কোম্পানি জেএমডি থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় নকুলের ‘নদীয়ার নকুল’ এবং ২০০৩ এএসডি অডিও কম্পানির ব্যানারে প্রকাশিত হয় ‘চাকরি নাই বুড়ো বাবার’ নামে আরেকটি অ্যালবাম। ভারত-বাংলাদেশে মিলে এভাবে তার প্রায় অর্ধশত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গান নিয়ে গেছেন ভারত, হংকং, কাতার, চীন, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেক উপাধিও অর্জন করেছেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তান পলক কুমার বিশ্বাস ও মেয়ে প্রত্যাশা বিশ্বাসকে নিয়ে নকুলের সুখের সংসার।
তার গানের মধ্যে ‘চাচায় চা চায়’, ‘এই আমার পকেটে আছে’, ‘মানুষটা পাঁচ ফিট’, ‘হ্যালো হ্যালো মাই ডিয়ার’, ‘মাগো তুমি যেন না কাঁদো’, ‘পাঁচতলার ওই চিলেকোঠায়’, ‘ভালো হইতে পয়সা লাগে না’ ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।
জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ছেড়ে নকুল নিজেই একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ছন্দে আনন্দ’ পরিচালনা করছেন গত দু’বছর ধরে। আসন্ন ঈদে নকুলের ব্যস্ততা তাই ছন্দ আনন্দ নিয়েই। ঈদের চতুর্থ দিন রাত সাড়ে ৮টায় নকুল কুমার বিশ্বাসকে দেখতে পাবেন দর্শক মাইক্রোফোন হাতে।
এছাড়া চ্যানেল আইতেও একটি লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নিবেন বলে জানান নকুল কুমার বিশ্বাস।
------------------রুদ্র হক